দুই ভাইয়ের লড়াই : অ্যাডিডাস বনাম পুমা

.
.

রাজায় রাজায় লড়াই—এ তো নতুন কিছু নয়। বাস্তব যুদ্ধে এক রাজা আরেক রাজাকে হারায়। তবে অর্থনীতির বাজারযুদ্ধে হারজিত ধারণাটা বেশ আপেক্ষিক। দুটি সক্ষম কোম্পানির মধ্যে লড়াই বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ায়, নতুন উদ্ভাবন হয়, আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। আবার লড়াইয়ের গল্পটাও কিন্তু চমকপ্রদ। যেমন অ্যাডিডাস ও পুমা। বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারী এই দুই জার্মান প্রতিষ্ঠানের নাম এখন সবার জানা। তবে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক যে আপন দুই ভাই, তা অনেকেরই অজানা। অ্যাডলফ বনাম রুডলফ: ঐতিহাসিক যে দ্বন্দ্বে জন্ম নিয়েছিল বিখ্যাত দুই ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস ও পুমা—সেই গল্পই বলব আজ।

রুডলফ ড্যাজলার ও অ্যাডলফ ড্যাজলার দুই ভাই। ১৯২০ সালে জার্মানির হ্যারজজেনুরেখে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন জুতা তৈরির কোম্পানি ‘ড্যাজলার ব্রাদার্স শু ফ্যাক্টরি’। বেশ জনপ্রিয়তা পায় তাদের এই কোম্পানি। বিখ্যাত দৌড়বিদ জেসি ওয়েনস ব্যবহার করতের তাদের তৈরি জুতাই। জনপ্রিয় এই মার্কিন ক্রীড়াবিদ বার্লিনে অনুষ্ঠিত ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, লং জাম্প ও ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে স্বর্ণপদক জয় করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। এমনই রমরমা অবস্থা ছিল ড্যাজলার ব্রাদার্স শু ফ্যাক্টরির।

তবে, দুই ভাইয়ের মিল বেশি দিন টেকেনি। বছর বিশেকের মধ্যেই ভাগ হয়ে যায় কোম্পানি। দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরুটা কিসের জেরে, তা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। প্রচলিত একটি গল্পটি হলো, রুডি (রুডলফ) ও এডির (অ্যাডলফ) মধ্যে বড় ভাই রুডি বেশ সুদর্শন ছিলেন, ছিলেন প্রাণোচ্ছল ও মিশুক। অন্যদিকে এডি কিছুটা চুপচাপ, তবে আবার উদ্ভাবনী মনোভাবের। একসময় এডির স্ত্রী ক্যাথির সঙ্গে রুডির একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এই অনৈতিক সম্পর্ককে কখনই ক্ষমা করতে পারেননি এডি। আর যার ফলে ভেঙে যায় সম্পর্ক। ভাগ হয় কোম্পানি।

আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে। আগেই বলা হয়েছে, ছোট ভাই এডি ছিলেন উদ্ভাবনী মনের। খেলাধুলার প্রতি ছিল তীব্র অনুরাগ। ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্সকে বাড়িয়ে তোলা যায়, এমন ‘স্পোর্টস শু’ তৈরির কথা ভাবতেন ছোটবেলা থেকেই। মায়ের লন্ড্রি ঘরের পেছনে বসে সেনাবাহিনীর জিনিসপত্র দিয়ে জুতা তৈরি করতেন এডি। ১৯২০ সালে তৈরি করেন জুতা তৈরির কারখানা, ১৯২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে তাতে যোগ দেন বড় ভাই রুডি। দুই ভাইকে খ্যাতি এনে দেয় নতুন ধরনের জুতা ‘স্পাইকড শু’। এই জুতা পুরোপুরি এডির পরিকল্পনায় তৈরি করা হয়েছিল। এরপরের গল্পটা কোম্পানির সাফল্যের। আন্তর্জাতিক নানা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক
পাচ্ছিলেন জার্মান অ্যাথলেটরা। যার একটা বড় কৃতিত্ব পাচ্ছিলেন ড্যাজলার ভাইয়েরা। তবে এই জুতা কার হাতে তৈরি, তা নিয়েও সম্পর্ক তিক্ত হয় দুই ভাইয়ের।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আর্থিক মন্দায় অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। শ্রমিক পাওয়ায় দুষ্কর হয়ে পড়ে, কারণ বেশির ভাগ মানুষকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে ‘ড্যাজলার ব্রাদার্স শু ফ্যাক্টরির’ মূল কর্তৃত্ব চলে যায় রুডলফের হাতে।
এ সময় এমনকি বোন মেরির ছেলেদের কোম্পানিতে নিতে অস্বীকৃতি জানান রুডি। পরে মেরির দুই ছেলেই যুদ্ধে যোগ দেন এবং নিহত হন। এতে পারিবারিক সমস্যা চরমে ওঠে।

১৯৪০ সালে যুদ্ধে চলে যান এডি। তবে কোম্পানিতে তাঁর প্রয়োজন অনেক বেশি—এমন অনুভব থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চলে আসেন। পরে ১৯৪৩ সালে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে যোগ দেন রুডলফ। একসময় সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন রুডলফ। বহু পরিকল্পনার পর নিজের শহরে ফিরে আসতে পারেন রুডি, তবে হিটলারের পেটোয়া বাহিনী গেস্টাপোর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং যুদ্ধের বাকি সময়টা তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। তখন কোম্পানির পুরো কর্তৃত্ব চলে যায় অ্যাডলফের হাতে।

যুদ্ধের শেষের দিকে কারাগার থেকে মুক্ত হলেও রুডলফের ভোগান্তি শেষ হয় না। যারা নাৎসি বাহিনীতে যুক্ত ছিল, তাদের খুঁজে বের করার কার্যক্রম শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আবার গ্রেপ্তার হন রুডলফ। অ্যাডলফ এ সময় তাঁর পাশে দাঁড়াননি বরং নাৎসি বাহিনী সঙ্গে রুডির সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

নাজি বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৯৪৬ সালে এবার গ্রেপ্তার হন অ্যাডলফ। রুডলফ দেখেন, ক্ষমতা নেওয়ার এটাই সুযোগ। তবে শেষ পর্যন্ত এডি নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং ছাড়া পান।

এসব নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৪৮ সালে ভাগ হয়ে যায় কোম্পানি। ভাগ হওয়ার দিন দুই ভাইয়ের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল, সেটিই ছিল শেষ কথোপকথন। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কথা হয়নি দুই ভাইয়ের মধ্যে। ১৯৭৪ সালে মারা যান রুডলফ, ১৯৭৮ সালে অ্যাডলফ।

১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট থেকে অ্যাডিডাস নামে আত্মপ্রকাশ করে অ্যাডলফের প্রতিষ্ঠান। এর আগের বছরই পুমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন রুডলফ। তখন থেকেই চলছে দুই কোম্পানির মধ্যে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে এই লড়াইয়ে সব সময় কিছুটা এগিয়ে অ্যাডিডাস। দুই ভাইয়ের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা এখনো হয়। কিছুদিন আগে সিনেমাও হয়েছে। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।