আড়াই শ টাকায় পেঁয়াজ বা টাকায় আট মণ চাল

শায়েস্তা খাঁ
শায়েস্তা খাঁ

পরিতোষ সেন ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। ‘জিন্দাবাহার’ বইয়ে তিনি সে সময়ের বাজারদর নিয়ে লিখেছেন, ‌‌‘আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঢাকায়, তথা পূর্ব–বঙ্গে থাবার–দাবারের স্বচ্ছলতা এবং অন্যান্য জিনিসের দাম অবিকল শেরশাহ–র যুগের মতো না–হ’লেও, এত সস্তা ছিল যে আজকের পাঠকেরা শুনে হয়তো তাই মনে করবেন। যেমনদু-আড়াই সেরি ইলিশ মাছ চার আনায়। এক-কুড়ি ডিম দু-আনায়। শীতকালে এক টাকায় কুড়ি দুই সের দুধ। ব্রহ্মদেশের সরু সেদ্ধ চাল তিন টাকায় এক মণ। এক ভরি সোনার দাম ষোলো টাকা। ছ’খানা ঘরের বারান্দা-উঠোনওয়ালা বাড়ির ভাড়া কুড়ি টাকা হ’লেও বেশি মনে হ’ত ।’

সবে সস্তার জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছেন শায়েস্তা খাঁ। মুঘল আমলে বাংলার একজন বিখ্যাত সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসক ছিলেন তিনি। দুই দফায় ২২ বছর তিনি বাংলা শাসন করেন। প্রথমে ১৬৬৪ থেকে ১৬৭৮ সাল এবং দ্বিতীয়বার ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল। বলা হয়, তাঁর শাসনামলে ঢাকার ব্যাপক উন্নতি হয়। শায়েস্তা খাঁ এখনকার মানুষের কাছে বেশি বিখ্যাত আছেন একটি বিষয়ের জন্য—তাঁর শাসনামলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।

যখনই কোনো নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখনই আমরা সেই শায়েস্তা খাঁর আমলের কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। পেঁয়াজের কেজি আড়াই শ টাকা, আর টাকায় কিনা আট মণ চাল! ভাবা যায়? এখন তো এক টাকারই অস্তিত্ব নেই বললে চলে। আসলেই কি শায়েস্তা খাঁর আমলে মানুষ এত সস্তায় চাল কিনতে পারত?

ঐতিহাসিকেরা অবশ্য বলছেন, বাংলার আরেক নবাব সুজাউদ্দীন খানের আমলেও (১৭২৭-৩৯) টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। তবে তাঁর কথা এখন আর কেউ বলেন না। ইতিহাস কাকে স্থান দেবে আর কাকে দেবে না, বোঝা মুশকিল।

১৯৬৪ সালের একটি পত্রিকার সংবাদ
১৯৬৪ সালের একটি পত্রিকার সংবাদ

এবার তাহলে ঐতিহাসিকদের কাছে যাই। তাঁরা দেখিয়েছেন, শায়েস্তা খাঁর আমলে ওই এক টাকা আয় করাই ছিল অত্যন্ত কঠিন। তখন বাংলার মানুষ ছিল অত্যন্ত গরিব। সে সময়ের অর্থনীতিকে বলা হতো খোরাকি অর্থনীতি। অর্থাৎ ফসল ভালো হলে সবাই দুই বেলা খেতে পারত, ফসল ভালো না হলে পরবর্তী ফসল না হওয়া পর্যন্ত প্রায় উপোস। আবার এমনও হয়েছে, কোনো কোনো সময়ে এত বেশি ফলন হতো যে চাহিদা কমে ধানের দামের ভয়াবহ পতন হতো। এতে কৃষকের কোনো লাভ হতো না, তখন টাকায় আট, এমনকি নয় মণ চালও পাওয়া যেত। এমনও হয়েছে, কৃষকেরা মাঠ থেকে ফসল তুলতেনই না। কারণ, ধান তোলার খরচই উঠত না। সুতরাং টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রাচুর্যের লক্ষণ ছিল না। খুব কম মানুষেরই সে সময়ে এক টাকা থাকত।

স্বাধীনতার পর এই বাংলাদেশেই তো মাত্র ৪০ টাকায় পাওয়া যেত এক মণ চাল। আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা শাসন আমলে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত। সুতরাং এক টাকায় কত মণ চাল পাওয়া যেত, সেটা মোটেই সমৃদ্ধির লক্ষণ না, বরং মানুষের হাতে টাকা ছিল কি না, সেটাই আসল, অমর্ত্য সেন যাকে স্বত্বাধিকার বলছেন অনেক আগে থেকেই।

শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার কথা যেমন সত্যি, তেমনি সামান্য কিছু মানুষের হাতে টাকা ছিল, এটাও সত্যি। তবে মানুষ মনে রেখেছে প্রথমটাই। শায়েস্তা খাঁ নিজেও হয়তো জানতেন এমনটাই হবে। আর তাই ঢাকা ত্যাগ করার সময় তিনি নগরীর পশ্চিম তোরণে নিম্নলিখিত লিপিটি উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন: ‘শস্যের এ ধরনের সস্তা বিক্রয়মূল্য প্রদর্শনকারীই একমাত্র এ তোরণ উন্মুক্ত করবে’।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সস্তায় চাল পাওয়া নয়, এই বাংলায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই বরং সাধারণ ঘটনা। ইতিহাস বলে, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ রাজের কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যায়। বাংলায় চালসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এরপর থেকে নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাধারমণ শীল সে সময়ের একজন কবি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটা এ রকম—

‘আগে তেল আট সের টাকায় পেয়েছি

সে তেলে এখন হায় সে তেল এখন,

তিন সের টাকাতেও না হয় ঘটন।

পূর্ব্বাপর এক বেটে অল্পমূল্যে লুণ।

এখন লুণের দরে লেগেছে আগুন।

ভেতো বাঙালীর সার ভরসা তুণ্ডুল।

বিদেশে চালানো তাহা হয়েছে ভণ্ডুল।

আগেতে টাকায় ছিলো দুধ কুড়ি সের।

আটসের পাইনাকো-অদৃষ্টের ফের।

ঘৃত ছানা মাখন কি করিব আহার।

শাক-ভাত খেয়ে কাল কাটা হল ভার।

এদিকে ওদিকে দুদিকে মারা যাই

বাঙালীর ভাগ্যে সুখ বুঝি আর নাই।’

১৮৬০ সালে লেখা কবিতাটি তো এখনো দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়।

তথ্য সূত্র: ঐতিহাসিকের নোটবুক, সিরাজুল ইসলাম। বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।