ব্যবসা শুরুর খুঁটিনাটি

চাকরি মানেই ৯টা-৫টায় অফিস। কখনো কখনো তা ৮টা-৮টায়ও হয়। চাকরি মানে নিজে খাটা। চাকরির মতো গৎবাঁধা জীবন যাঁরা চান না বা তুলনামূলক স্বাধীনচেতা মানুষ যাঁরা, তাঁরাই বেছে নেন ব্যবসার পথ। আর ব্যবসা মানে অন্যদের চাকরি দেওয়া বা খাটানো, উদ্যোক্তারা যে বিষয়টিকে বলে থাকেন ‘চাকরি করব না, চাকরি দেব।’

হাজার রকমের ব্যবসা রয়েছে দেশে। এদিকে রয়েছে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় আকারের ব্যবসা। অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনশীল, ট্রেডিং ব্যবসা। কাঁঠালপাতা দিয়ে ঠোঙা বানানোর ব্যবসা যেমন রয়েছে, আবার রয়েছে ইস্পাত উৎপাদনের ব্যবসাও। কেউ আবার বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে দেশীয় বাজারে তা বিক্রি করেন। আবার কেউ দেশে উৎপাদন করে বিদেশের বাজারে রপ্তানি করেন। কী ব্যবসা শুরু করতে চান, তা ব্যবসা যিনি করবেন, তাঁকেই ঠিক করতে হবে।

টাকার সংস্থান

উদ্যোক্তা ছোট হোক বা বড় হোক, যে ধরনের ব্যবসার পরিকল্পনা করছেন, তা বাস্তবায়ন করতে গেলে কী পরিমাণ মূলধন লাগবে, তা আগেই তাঁকে ঠিক করতে হবে। তার পরের চিন্তা টাকা আসবে কোথা থেকে। নিজের কাছে থাকলে তো কথাই নেই। না থাকলে কতটা নিজের, কতটা ব্যাংকঋণ, কতটা গয়না বিক্রি, কতটা আত্মীয়স্বজন থেকে ধার ইত্যাদি ছক কষতে হবে। আবার নিজের সংসারের মাসিক খরচের কথাটাও ভুললে চলবে না।

গরুর নাড়িভুঁড়িকে রপ্তানি পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াছ এ নিয়ে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় ব্যবসার বড় পুঁজি হচ্ছে জেদ। জেদ থাকলে ব্যবসা হবেই। সঙ্গে অবশ্য একটা ভাগ্যের ছোঁয়াও লাগে।’

মোহাম্মদ ইলিয়াছের জবানিতে আরও শোনা যায়, ‘যেকোনো ব্যবসায়ই পরিশ্রম বেশি। আমি বলব, খুব সকালে যিনি ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না, তাঁর পক্ষে ব্যবসা করা অসম্ভব। আর নতুন কোনো ব্যবসা করতে গেলে সবার আগে লাগে ধৈর্য। ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। ধৈর্য হারালেই ব্যবসা শেষ।’

অঙ্ক জানা জরুরি

ব্যবসা কিন্তু ব্যবসাই। এর প্রথম ও শেষ কথা হলো মুনাফা। আগে যাচাই করতে হবে মুনাফাটা হবে কি না। আর সে জন্যই অঙ্কটা দরকার। আপনি যদি কাঁঠালপাতা দিয়ে ঠোঙা বানানোর ব্যবসায় নামেন, হিসাব করুন আগে কাঁঠালপাতা কোথা থেকে আনবেন। আনার পরিবহন খরচ এবং কর্মচারীর মজুরিও মাথায় রাখুন। পুঁজি বিনিয়োগের একটা খরচ আছে। আছে বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি। সব খরচসহ হিসাব করতে হবে মুনাফাটা কত ধরতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের বোনাফাইড নিটিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, কোনো একটা ব্যবসা করতে গেলে এর ভিতর-বাহির জানা থাকাটা আগে জরুরি। কোথায় কাঁচামাল পাওয়া যায়, কম দামে কোথায় পাওয়া যায়, কোথায় বিক্রি করলে মুনাফা বেশি পাওয়া যায় ইত্যাদি। কেউ যদি কোনো পণ্য উৎপাদনে যেতে চান, সেই পণ্যের কারখানায় তাঁর চাকরির অভিজ্ঞতা অনেক সময় বাড়তি সুবিধা দেয় বলেও মনে করেন ওয়াহিদুজ্জামান।

লাইসেন্স বাধ্যতামূলক

ব্যবসার অবস্থান অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। যদি অংশীদারি ব্যবসা হয় বা লিমিটেড কোম্পানি হয়, তাহলে নিবন্ধন নিতে হবে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে। আমদানি বা রপ্তানি করতে চাইলে নিবন্ধন নিতে হবে প্রধান আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে।

আরজেএসসির উপনিবন্ধক আবু ইসা মোহা. মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, কোম্পানি করতে গেলেই আরজেএসসির নিবন্ধন লাগবে। তার আগে অবশ্য নামের ছাড়পত্রের আবেদন করতে হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরজেএসসির নিবন্ধনও যথেষ্ট নয় জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ যদি বিমা ব্যবসা করতে চান, তাহলে তাঁকে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন নিতে হবে।

ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসাব

ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব থাকলেও ব্যাংকে ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসাব খোলা এখন জরুরি। ব্যবসা বড় করতে চাইলে ব্যাংক থেকে যখন ঋণ নিতে হয়, ব্যাংক তখন লেনদেনের পরিমাণ ও প্রবণতাটা দেখে। এটা ভালো হলে ব্যাংকঋণ দেয়। ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে এখন অবশ্য বিআইএন লাগে। বিআইএন হচ্ছে ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বর (বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর)। সরকারি কোষাগারে শুল্ক-কর দেওয়ার কোনো কাজই করা যাবে না এখন এই বিআইএন ছাড়া।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস্ উল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসাব না থাকলে এই যুগে কেউ ব্যবসাই করতে পারবে না। আমি বলব, ব্যাংকে লেনদেন ভালো করুন। টাকার জন্য ঠেকবেন না। ব্যাংক টাকা নিয়ে আপনার ঠিকানায় যাবে।’