'নয়-ছয়' করে দেড় বছর, এখন আবার কমিটি

ব্যাংকঋণের সুদহার হবে এক অঙ্কের—দেড় বছর ধরে এ নিয়ে নানা আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ফল আসেনি; বরং ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমে গেছে, আসছে না আমানতও।

এদিকে সুদহার না কমলেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে গত ৯ মাসেই বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ জন্য এখন সব দোষ দেওয়া হচ্ছে ঋণের উচ্চ সুদহারকে।

দেড় বছর ধরে কাজ না হওয়ার পর গত সোমবার এ জন্য নতুন করে আবার একটি কমিটি করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তবে এই কমিটি নিয়েও খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সুদহারই একমাত্র সমস্যা নয়, ব্যাংকের তহবিল খরচ কমাতে হবে, শাস্তি দিতে হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী গত রোববার সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে সময় তিনি বলেছেন, খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে ঋণের উচ্চ সুদ। এই সুদ এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে হবে, যা কার্যকর করা হবে আগামী জানুয়ারি থেকে।

শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এ বিষয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক অঙ্কের সুদের হারের কথা এক-দেড় বছর ধরে শুনছি। কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। একেকবার একেক কথা বলা হচ্ছে। গত রোববার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’

এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ‘মূল্য সংযোজন কর ও ব্যাংকের সুদ দিতে দিতেই ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সুতরাং সরকার ও ব্যাংক মিলে সিদ্ধান্ত নিলেই তো তা কার্যকর হবে না। ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে হবে। আমার প্রশ্ন, সিদ্ধান্ত কার্যকরে সব পক্ষের সঙ্গে কি আলোচনা হয়েছে? বিশেষজ্ঞ মতামত কি নেওয়া হয়েছে?’

>

অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার জন্য ব্যাংকের উচ্চ সুদকে দায়ী করলেও ব্যাংকাররা বলছেন উল্টো কথা।

 এদিকে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ব্যাংকমালিকেরা গত দেড় বছরে সরকারের কাছ থেকে ঠিকই নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার ১ শতাংশ কমানো, রেপোর সুদহার ও করপোরেট কর কমানো ইত্যাদি। মাঝে আবার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক এবং টানা ৩ বছরের পরিবর্তে টানা ৯ বছর বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে থাকার বিধানও করে দেয় সরকার।

এত সুবিধা পেয়েও কেন সুদহার কমছে না—জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের চাহিদা অনুযায়ী আমানত মিলছে না। সরকার ৫০ শতাংশ আমানত দিতে চাইলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ঋণ-আমানত অনুপাত সমন্বয়ের চাপ আছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলো চাইলেও সুদহার কমাতে পারছে না।’ কম সুদে আমানত পেলে কম সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।

উদ্যোক্তারা কী বলছেন

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের কারণে সুদের হার বেশি, না উচ্চ সুদের হারের কারণে খেলাপি ঋণ বেশি—এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বইকেনা’ গল্পের একটি উদ্ধৃতির কথা মনে করিয়ে দেন। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে, ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলেই বই সস্তা করা যায় না।’

 খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য উচ্চ সুদের হার দায়ী বলে মনে করেন কিছু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। আবার অনেকেই কেবল শুধু উচ্চ সুদকে দায়ী করতে রাজি নন। তাঁদের মতে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যেমন এর পেছনে রয়েছেন, ব্যাংকের মালিকপক্ষের অতি মুনাফা করার প্রবণতাও এর জন্য কম দায়ী নয়। আরও রয়েছে ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘দেখা গেছে, একটি প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলো। প্রকল্পটি চলতে গেলে আরও ২ কোটি টাকা চলতি মূলধন দরকার। কিন্তু দিচ্ছে ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি পরে ব্যর্থ হয় এবং খেলাপি হয়।’

কয়েকটি ব্যাংক এবং কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো অনেক সময় যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের লোকেরাই শিখিয়ে দেয়, বেশি ঋণ পেতে গেলে কীভাবে আবেদন করতে হবে। আবার ব্যাংক জেনেশুনেই খারাপ গ্রাহককে ঋণ দেয়। ব্যাংক যখন ঋণের টাকা আদায় করতে পারে না, তখনই বাধে বিপত্তি। হিসাবের খাতায় খেলাপির আকার বাড়তে থাকে।

শিল্প গ্রুপ আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, দেখা গেল ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প ভালোভাবে যাচাই না করেই ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে দিল। স্বাভাবিক কারণেই এই টাকা নয়ছয় হয়। সুদের হার কমাতে হবে, পাশাপাশি এ বিষয়গুলোও ঠেকাতে হবে। আর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হচ্ছে মরাকে আরও মেরে ফেলা। এটাও বাদ দিতে হবে। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি পাওয়া উচিত।

 ব্যাংকারদের যুক্তি

 বর্তমানে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা যে খেলাপি ঋণ আছে, তা থেকে ব্যাংকগুলোর কোনো আয় হচ্ছে না। যদিও বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে, নগদ ও সংবিধিবদ্ধ জমাও করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফলে খেলাপি ঋণের চাপ গিয়ে পড়ছে নিয়মিত ঋণের ওপর। এতেই বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের তহবিল খরচ, যার প্রভাবে সুদহার বাড়ছে।

ব্যাংকের সুদ হিসাব করার পদ্ধতি প্রসঙ্গে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি এম শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তহবিল ও পরিচালনা খরচ মিলেই ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের টাকা খেলাপি হয়ে পড়লে বড় সমস্যায় পড়তে হয়। ওই টাকার জন্য অন্য আয় থেকে সঞ্চিতি রাখতে হয়। আমানতকারীদেরও টাকা দিতে হয়। এসব কারণে সুদহার বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণ কমানো গেলে সুদহার কমে আসবে।’

সব মিলিয়ে ব্যাংকাররা বলছেন, খেলাপি ঋণ নতুন রোগ নয়। আর সুদহার বাড়ে-কমে। ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল যখন সহজলভ্য হয়, তখন ঠিকই সুদহার কমে যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে সুদহার এক অঙ্কে নেমে এসেছিল।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট আছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কম। ঠিক এই সময়ে সুদের হার কমাতে বলা হচ্ছে। সময়টা ঠিক উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। ফলে সুদের হার না কমে উল্টো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।