দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী

একটি বাদে অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখন নিম্নমুখী। রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই, আমদানিতেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে নতুন আইন করার পরেও ভ্যাট আদায় মোটেই বাড়েনি।

একমাত্র স্বস্তির সূচক প্রবাসী আয়। এ ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকেই ভালো নেই দেশের অর্থনীতি। আরও খারাপ খবর হচ্ছে, আয় কম থাকায় সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বহু বছর ধরেই স্থবির। চলতি অর্থবছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়া অনেক কমে গেছে। এর প্রভাব হচ্ছে, পুঁজি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে কম, নিষ্পত্তিও কম; বরং ভালো অবস্থায় আছেন কেবল ঋণখেলাপিরা। সুযোগ-সুবিধা পেয়েই যাচ্ছেন, কিন্তু বিনিয়োগে এর প্রভাব নেই। অন্যদিকে শেয়ারবাজার তো দীর্ঘদিন ধরেই পতনের ধারায়।

বিশ্বজুড়ে এখন মন্দার আশঙ্কা। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে সেখানে প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে সাড়ে ৪ শতাংশে। দ্রুতগতিতে ছোটার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিও মন্দাদশায় পড়তে যাচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন এখন অনেকেরই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে অর্থনীতি গর্তে পড়ে গেছে, দেশটি এই গর্ত আরও গভীর করছে। আমাদের সূচকগুলো বিবেচনা করলে আমরাও একই দিকে যাচ্ছি। প্রবাসী আয় বাড়লেও প্রবাসীর সংখ্যা কমছে। ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় আসারও প্রবণতাও কমে যাবে। সার্বিকভাবে অর্থনীতির যে চাঙাভাব আশা করছি, তা আর থাকবে না। আমরাও গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি।’

শুরুতে ভালো সংবাদ
সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে অনেক নারী শ্রমিক ফিরে আসছেন। ভয়াবহ নির্যাতনের এসব খবরের মধ্যেও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময় তা ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার এখন ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।

>

অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে সব খাতে। একমাত্র ভালো খবর প্রবাসী আয়ে।

কয়েক বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে প্রায় একই হারে ধরে রাখা হচ্ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে চীন ঘোষণা দিয়ে তাদের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করে। এরপর টিকে থাকতে প্রতিযোগী দেশগুলোও নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু করে। বাংলাদেশ টাকার অবমূল্যায়ন না করে বিকল্প হিসেবে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, আলাদা করে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা না দিয়ে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করলে রপ্তানি খাতসহ প্রায় সবাই একই সঙ্গে লাভবান হতে পারত। চাপে পড়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করেছে।

আয় কমছে সরকারের
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাত। আর এ খাতেই এখন প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম সাড়ে ১২ শতাংশ আর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০০১–০২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে নেগেটিভ বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

রপ্তানি খাতে আরও খারাপ খবর আছে। যেমন বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে পোশাক রপ্তানিতে এগিয়ে যাচ্ছে ভিয়েতনাম। বিশ্বের ১০ শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পোশাক রপ্তানিতে দেশটি বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অনেক ক্রয়াদেশ ভিয়েতনামে চলে গেছে। চীনা বিনিয়োগকারীরাও ভিয়েতনামে ভিড় করছে। এবারের বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল বাংলাদেশ নিতে পারছে না। ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনার ব্যয় কমাতেও বড় সাফল্য দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ।

আয় নিয়ে আরেক বড় দুশ্চিন্তার নাম রাজস্ব খাত। বিশাল আকারের বাজেট দিয়ে এখন আয় নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। সামগ্রিকভাবে চলতি প্রথম চার মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতেই আদায় কমেছে। তিন খাত হলো আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক-কর, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট এবং আয়কর। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর থেকেই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর চালু করা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক কিছুই ঠিকঠাক নেই। ফলে ভ্যাট আদায় কমে গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগের সদস্য কানন কুমার রায় এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবারই বছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে কর ফাঁকি রোধ করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বাড়াতে আইনি কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এতে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আমদানি ব্যয়েও প্রবৃদ্ধি হয়নি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে আড়াই শতাংশ। এ সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি নিষ্পত্তি কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামালে কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রপ্তানি ও আমদানি কমে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মন্দার কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। এরই প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।

বিনিয়োগ এখনো স্থবির
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক খাত থেকে বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে অনেক কম। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৬৪ শতাংশ। ঋণ ও আমানতের সুদহার হবে নয়-ছয় শতাংশ, সরকার এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। উল্টো ব্যাংক খাতে আমানত কমে গেছে, ঋণের সুদহার আগের মতোই বেশি, আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত নিয়ে ‘নয়-ছয়’ করায় সামগ্রিক অর্থনীতির সংকটই আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘুরে দাঁড়াবার পরিবর্তে স্থবির হয়ে পড়েছে বিনিয়োগ খাত।

বাড়ছে ব্যয় ও সরকারি ঋণ
সরকারের ব্যয় এখন অনেক। দেওয়া হয়েছে বিশাল বাজেট। অথচ অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আয়ে ঘাটতি থাকলেও সরকারের ব্যয় মোটেই কমেনি। এতে সরকারের ঋণ গ্রহণও বেড়ে গেছে। এ নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন এক সংকট। বিনিয়োগের অন্য কোনো নিরাপদ উৎস না থাকায় কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছিল অনেক বেশি। সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বেশি। এ কারণেও সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ৩ ভাগের ১ ভাগ হয়ে গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণেই বিক্রি কম বলে মনে করা হচ্ছে। এতে সরকারের দায় কমবে ঠিকই, অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বেড়ে যেতে পারে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ার অর্থই হচ্ছে বেসরকারি খাতের ভাগ কমে যাওয়া। এতে বিনিয়োগে দেখা দেবে নতুন সংকট।

সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকেই মন্দার আভাস। রাজস্ব, রপ্তানি, ঋণ—এসব কোনোটির পরিস্থিতিই তেমন ভালো নয়। আগে একসঙ্গে এত সূচকের খারাপ অবস্থা দেখা যায়নি। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ আনতে বড় সংস্কার লাগবে। নগদ সহায়তা বা কর সুবিধার মতো প্রণোদনা দিয়ে কাঠামোগত সমস্যা দূর করা যাবে না। তিনি আরও মনে করেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির সূচকগুলো যে খারাপ, তা সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। স্বীকৃতি দেওয়া হলে সমস্যা সমাধানের কথা উঠত। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের সমস্যা সাময়িক, শিগগিরই কেটে যাবে। তবে সমস্যা এখানেই।