এমডিরা নিলামের মাধ্যমে টাকা কিনে আনছেন এখন

>ব্যাংকে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয় দেড় বছর আগে। সুদহার কমানোর কথা বলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধাও নিয়েছে। তবে সুদহার এখনো একক অঙ্কে নেমে আসেনি। এ অবস্থায় সুদহার কমাতে নতুন করে আবারও কমিটি গঠন করেছে সরকার। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব
নজরুল ইসলাম মজুমদার
নজরুল ইসলাম মজুমদার

প্রথম আলো: দেড় বছর আগে আপনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার। কিন্তু এত দিনেও তা বাস্তবায়ন হলো না কেন?
নজরুল ইসলাম মজুমদার: দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমরা সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলাম। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে অনেক শিল্পকারখানা টাকা ফেরত দিতে পারে না। এ কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। এ জন্য আমরা সুদ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ওই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সব ধরনের সহায়তা করা হবে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে যে আমানত রয়েছে, তার ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংককে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে ২৫ শতাংশ সরকারি আমানতও আমরা পাইনি। অথচ দেশের ব্যাংক খাতে যে ঋণ রয়েছে, তার ৮০ শতাংশই বেসরকারি ব্যাংকের। সে হিসাবে সরকারের বেশির ভাগ আমানত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে থাকার কথা। সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে আমরা ব্যাংকিং করছি। এ কারণে সুদহার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামেনি।

তবে ২০১৭ সালের শুরুতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। তখন টাকার সরবরাহ ভালো ছিল, চাহিদা কম ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, টাকার চাহিদা বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। আর ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে। আরেকটা বিষয় হলো, জোগান ও চাহিদা সুদহার ঠিক করবে। এটা সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। করা গেলে সব ব্যাংকের সুদহার এক হতো। তবে অর্থনীতির স্বার্থে সুদহার এক অঙ্কে আনার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: সুদহার তাহলে সহসাই কমবে না। নাকি নতুন করে কোনো সুবিধা পেলে আবারও কমানোর ঘোষণা দেবেন?

নজরুল ইসলাম মজুমদার: চাহিদা এখন এত বেশি বেড়ে গেছে, তাই টাকা লাগবেই। কারখানাগুলো চালাতে টাকা না দিলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, একটি কারখানা যে ব্যবসা করছে, সে পরিমাণ আয় করতে পারছে না। আমরা এরপরও কারখানাটি বাঁচিয়ে রাখতে তাদের অর্থায়ন করছি। আমরা জেনেশুনে জাতির স্বার্থে তাদের টাকা দিচ্ছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মতে, প্রচলিত ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ৮৫ শতাংশ ও ইসলামি ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে (ঋণ আমানত অনুপাত বা এডিআর) পারে। এটা ১ শতাংশ বাড়ানো হলে টাকার সংকট কিছুটা কমবে। আবার নগদ জমার হার (সিআরআর) কিছুটা কমিয়ে আনলে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এতে সুদহার কমে আসবে।

প্রথম আলো: দিনে দিনে টাকার চাহিদা আরও বাড়বে। আমানত তো সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে সুদহার কমবে?

নজরুল ইসলাম মজুমদার: এ জন্য আমরা অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে জানিয়েছি, একটা ফর্মুলা বের করার। ব্যাংক খাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ও ব্যাংকগুলো তদারক করে। তারা নিশ্চয়ই সুন্দর একটা ফর্মুলা বের করবে। সেটা এডিআর বা সিআরআরে পরিবর্তন এনে বা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে।

দেখুন, এডিআরের সীমা ধরে রাখতে ব্যাংকের এমডিরা পাগল হয়ে যায়। এমডিরা এখন নিলামের মাধ্যমে টাকা কিনে আনছে। আগে কখনো টাকার জন্য এমন নিলামের ব্যবস্থা ছিল না। যেহেতু টাকার চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাই নিলামে টাকা নিয়ে আসতে হচ্ছে। গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে আমরা এভাবেই টাকা নিয়ে আসছি। সরকারি ব্যাংকে তো এমন সমস্যা নেই। কারণ, সরকারি ব্যাংক লোকসান করলে আবার টাকা পাচ্ছে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। বছর শেষে কমপক্ষে ১০ শতাংশ বোনাস দিতে না পারলে তারা আমাদের এজিএম মঞ্চ ভেঙে ফেলে। আর আমরা ব্যবসা করছি সাধারণ মানুষের টাকায়। একটি ব্যাংকে আমাদের পরিচালকদের আর কত টাকা। সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি।

একদিকে ঋণের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। আবার কোনো শিল্প রুগ্‌ণ হয়ে পড়লে বড় অঙ্কের ধরা খেয়ে যায়। এ জন্য ধার করে বেশি সুদে হলেও আমাদের টাকা সংগ্রহ করতে হয়। কোনো শিল্প যাতে রুগ্‌ণ না হয়ে পড়ে, তা আমাদের দেখতে হয়।

প্রথম আলো: বেশি সুদের কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে, নাকি বেশি খেলাপির কারণে সুদ বাড়ছে?

নজরুল ইসলাম মজুমদার: বেশি সুদের কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে, এটা পুরোপুরি সত্য না। এক্সিম ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণ শিল্প খাতে। এসব ঋণে সুদহার ১১-১২ শতাংশ। তারা সবাই নিয়মিত ঋণ ফেরত দিচ্ছে। আবার ছোট ব্যবসায়ীরাও নিয়মিত টাকা ফেরত দিচ্ছে। তবে মাঝারি ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। তাই সুদহারের কারণে খেলাপি হওয়ায় বিষয়টি আংশিক সত্য।

আরেকটা বিষয় হলো, সব বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালন খরচ অনেক বেশি। একটা ছোট আকারের ব্যাংকের ২৫-৩০ কোটি টাকা বেতনসহ নানা খরচে চলে যাচ্ছে। এসব নিয়ে কথা উঠেছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সুদহারে কিছুটা প্রভাব পড়বে।