বড় স্বপ্নপূরণের পথে কিনশিপ এআই

তৈরি পোশাকশিল্পে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার অনেক কাজই সহজ করে দিচ্ছে
তৈরি পোশাকশিল্পে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার অনেক কাজই সহজ করে দিচ্ছে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) এ যুগে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও পিছিয়ে নেই। ‘কিনশিপ এআই’ নামের একটি উদ্যোগ দেশের তৈরি পোশাক খাতের গণ্ডি পেরিয়ে ছুটছে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে। কিনশিপ এআই বিশেষ চ্যাট বটযুক্ত কারখানার কর্মশক্তি প্ল্যাটফর্ম (ফ্যাক্টরি ওয়ার্ক ফোর্স প্ল্যাটফর্ম)। এটি মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক অনন্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিক ও কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনার একটি মাধ্যম। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক ও কর্মচারীদেরকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যুক্ত করে সাপ্লাই চেইনে টেকসই উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা যুক্ত করতে পারে।

২০১৬ সালে এর যাত্রা শুরু। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলেন এসকিউ গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুকের মেয়ে বোটাইনা ফারুক। ভালুকা ও মাওনাতে পাঁচটি পোশাক কারখানা রয়েছে তাঁদের। কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, তাঁদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানা ও খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ভাবতে থাকেন নতুন একটি যোগাযোগের মাধ্যম দাঁড় করানোর। এ কাজে সহযোগিতা করেন তাঁর স্বামী রামিজ হক। তাঁদের উদ্যোগে এসকিউ গ্রুপে নতুন প্রকল্প হিসেবে যাত্রা শুরু করে পোশাককর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ‘কুটুম্বিতা’ অ্যাপ। সেই কুটুম্বিতাকে বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করার উদ্যোগ হিসেবে তাঁদের হাত ধরে এসেছে এই কিনশিপ এআই নামের প্ল্যাটফর্মটি।

দেশের কয়েকটি পোশাক কারখানা ও বিদেশের জিওলিঙ্গোর মতো ব্র্যান্ডের মধ্যে কিনশিপ এআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে আগ্রহ দেখা গেছে। ২০১৭ সালে বোটাইনা ও রামিজের সঙ্গে যুক্ত হন আলভি আওয়াল, শাহরিয়ার রহমান ও শাফকাত আলম। আলভি ও শাহরিয়ার মূলত ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখছেন। প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন শাফকাত।

রাজধানীর গুলশানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর অফিস থেকেও এর বৈশ্বিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। বর্তমানে ১২ জনের মতো কর্মী কিনশিপ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

দেশে কিনশিপের হেড অব অপারেশন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আলভি জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে নতুন উদ্যোগে যুক্ত হন। রামিজ ও বোটাইনা সিঙ্গাপুর থেকে কিনশিপের বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের তৈরি প্ল্যাটফর্মটি শিগগিরই কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের মতো দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার শুরু হবে। বিশ্বের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগও পেয়েছে তাঁদের এ উদ্যোগ।

সাভারের একটি তৈরি পোশাক কারাখানায় চাকরি করেন সীমা বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, তাঁর কাছে থাকা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে একটি অ্যাপ রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি সহজেই বাড়িতে বসেই ছুটির আবেদন করে ফেলতে পারেন। সেই আবেদন দেখে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ কর্মকর্তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এসকিউ গ্রুপের ডেপুটি চিফ পিপল অফিসার জোহান আহমেদ বলেন, তাঁরা কিনশিপের একটি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন, যা দিয়ে কর্মীদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায়। তাঁদের কারখানার ১৭ হাজারের মতো কর্মী এটি ব্যবহার করছেন। কর্মীদের কাছে কোনো তথ্য দেওয়া বা তাঁদের কাছ থেকে জবাব জানার মতো নানা কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ছুটির দরখাস্ত বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ সহজ হয়েছে। কোনো জরিপের কাজেও এটি ব্যবহার করা যায়। এটি মূলত কাগজ ও কলমের ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এটি দৈনন্দিন কাজকর্ম অনেক সহজ করেছে। বিশেষ করে পোশাক কারখানায় কোনো নিপীড়নের ঘটনা সরাসরি কর্তৃপক্ষকে জানানোর সুযোগ আছে এতে।

আলভি আওয়াল, অন্যতম উদ্যোক্তা
আলভি আওয়াল, অন্যতম উদ্যোক্তা

কিনশিপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রামিজ হকের ভাষ্য, এটি মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মটি তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিক ও কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনার এক অত্যাধুনিক মাধ্যম। বর্তমানে দেশের ১০টি কারখানায় ৩০ হাজারের বেশি কর্মীকে এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা শাফকাত আলম বলেন, প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অফিস ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় হয় বলে এতে কারখানা পরিচালনার খরচ কমে আসে। কিনশিপ এআই মূলত কিয়স্ক, এসএমএস ও অ্যাপ তিনভাবে কাজ করে। এতে কর্মীরা সরাসরি অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। কিয়স্কের মাধ্যমে কারখানায় সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারের অনেক জটিল কাজ সহজ হয়ে যায়। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মতো ফোনে বা সাধারণ ফিচার ফোনেও কর্মীরা এতে যোগাযোগ করতে পারেন।

কিনশিপে কয়েকটি মডিউল আছে। এর মধ্যে সহজে যোগাযোগ করার মডিউলটির নাম কানেক্ট। এনগেজড মডিউলে অটোমেটেড এনগেজমেন্ট বা প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ রয়েছে। সরাসরি কোনো সমীক্ষা বা জরিপের কাজে ব্যবহার করা যায় চ্যাট বট। মোবাইল এইচআরের মাধ্যমে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে। ব্যবহারকারীর দেওয়া তথ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে কর্মীদের মনোভাব আগে থেকে বুঝতে পারা যায়। এতে কর্মীর ঝুঁকি, সন্তুষ্টি, স্বাস্থ্য, হাজিরার মতো বিষয়গুলো আগাম পূর্বাভাস জানা যায়।

গত বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিনে টেকস্টারস ইমপ্যাক্ট প্রোগ্রাম থেকে মঞ্জুরির পাশাপাশি হিউম্যানিটি ইউনাইটেড নামের অমিডায়ার নেটওয়ার্ক থেকে তহবিল পায় তারা। কিনশিপ সম্পর্কে আলভি বলেন, সাভারের ইপিজেডে জিইবি ও গাজীপুরের অপলুনের দুটি কারখানায় কিনশিপের কিয়স্ক ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গেইন নামের একটি সংস্থা তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানায় শ্রমিকের পুষ্টি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। তবে কিনশিপ শুধু যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি পুরো গার্মেন্টস খাতের ওয়ার্কফোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সনির্ভর প্রযুক্তি গ্রহণ করছে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলো। সে ক্ষেত্রে দেশি উদ্যোক্তাদের তৈরি কিনশিপের বড় ধরনের সম্ভাবনা দেখছেন এর উদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ায় তাদের স্বপ্ন সফল হওয়ার পথে।