অর্থনৈতিক-সামাজিক খাতের প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানের ওপরে বাংলাদেশ

২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করবে। তার আগেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ছবি: সাইয়ান
২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করবে। তার আগেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ছবি: সাইয়ান

দুই বছর আগেই মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬৫২ ডলার। ওই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫১ ডলার। পরের বছর তা আরও বেড়ে হয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় কমে ১ হাজার ৪৯৭ ডলারে নেমে যায়। এভাবেই কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানের ওপরে উঠে গেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম ভিত্তি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থসামাজিক বৈষম্য। জনসংখ্যা বেশি হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তুলনামূলক কম বরাদ্দ পেত। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদ্‌যাপন করবে। তার আগেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। যেমন, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এখন পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয় ও পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে বাংলাদেশের তথ্য–উপাত্তের তুলনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া খুবই সন্তুষ্টির বিষয়। বৈষম্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশের ভালো করার স্পৃহা ছিল। আর পাকিস্তান নানা ধরনের অস্থিরতার কারণে পিছিয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, শুধু পাকিস্তান নয়, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর মতো মানব উন্নয়ন সূচকের কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতি
মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রা। বিশেষ করে এক দশক ধরেই এ দেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি গোটা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর দেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নামেনি। অন্যদিকে গত দেড় দশকে পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। মাথাপিছু আয়ে গত এক দশকে বাংলাদেশে দ্বিগুণের বেশি হলেও পাকিস্তানে মাত্র ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

>

গত এক দশকে প্রায় সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

কাগজে-কলমে এখন পাকিস্তানে বেকার বেশি। বাংলাদেশে যেখানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ সেখানে পাকিস্তানে তা প্রায় ৩৮ লাখ। বেকারত্বের হার বাংলাদেশে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, আর পাকিস্তানে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

শ্রমশক্তিতে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। বাংলাদেশের ১ কোটি ৮৫ লাখ নারী মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। পাকিস্তানে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থাৎ পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ বেশি নারী কাজ করেন।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, যা অনেক ভবিষ্যৎমুখী। সরকারের নীতিগুলোও বাজারমুখী। এতে সমাজের নিচের স্তরে থাকা মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে।

সামাজিক খাত
পাকিস্তানিদের চেয়ে এখন বাংলাদেশিরা গড়ে ছয় বছর বেশি বাঁচেন। বাংলাদেশে গড় আয়ু এখন ৭২ দশমিক ৩ বছর, যা পাকিস্তানে ৬৬ দশমিক ৬ বছর।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতে জন্মনিয়ন্ত্রণে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশে কয়েক বছর ধরেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ২ শতাংশ, যা দুই বছর আগে ছিল ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার এখন ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানে এই হার ৫৭ শতাংশ। বাংলাদেশের নারী-পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় কাছাকাছি থাকলেও পাকিস্তানে নারীরা শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে।

এক বছর বয়স হওয়ার আগে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় ২২ জন, আর পাকিস্তানে মারা যায় ৬১ জন শিশু। জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে নানা রোগশোকে প্রতি হাজারে এ দেশে মারা যায় ২৯ জন, পাকিস্তানে তা ৭৪ জন। গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের কারণে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১৬৯ জন মা মারা যান। পাকিস্তানে মারা যান ১৭৮ জন মা।