উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে হবে

আবু মোর্শেদ চৌধুরী, সভাপতি কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
আবু মোর্শেদ চৌধুরী, সভাপতি কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
>

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও মেরিন ড্রাইভ সড়ক, নানা ঐতিহ্য ও পাহাড়-ঝরনার সৌন্দর্য পর্যটকদের কক্সবাজারে টানে। এখানে ঠাঁই পেয়েছে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। চলছে ৬৯টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এসব নিয়ে কথা বলেছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুল কুদ্দুস

প্রথম আলো: কক্সবাজারে পর্যটনের অবস্থা বলুন।

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার কারণে কক্সবাজারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আগমন বেড়েছে। ফলে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা বেড়েছে। তবে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও এখানে পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না। সমুদ্রে গোসল করা আর সূর্যাস্ত দেখা ছাড়া বিনোদনের কিছু নেই। তাই বহুমাত্রিক পর্যটনের বিকাশে জোর দিতে হবে।

প্রথম আলো: কক্সবাজারে এখন সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। তাদের প্রত্যাবাসনও অনিশ্চিত। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে কেমন?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্যচাহিদা পূরণে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার ও কক্ষ ভাড়া এবং দর্শনীয় স্থানসমূহে যাতায়াতের খরচ বেড়েছে। রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠার পর কক্সবাজারের ইকো ট্যুরিজম, বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফের বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

প্রথম আলো: ছুটি পেলেই কক্সবাজারে ছুটে আসেন লাখো পর্যটক। কিন্তু সমুদ্রে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নেই। নেই বিনোদনের ব্যবস্থাও। কারণ কী?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: দীর্ঘদিন ধরে আমরা বলে আসছি, সৈকতে নিরাপদ গোসলের নেটিং সিস্টেম চালু হোক। এতে স্বচ্ছন্দে গোসল করতে পারবেন পর্যটকেরা। পানিতে ডুবে প্রাণহানির ঘটনাও বন্ধ হতো। কিন্তু আন্তরিকতার অভাবেই তা হচ্ছে না। সন্ধ্যার পর অনেকেই হেঁটে শহরটা দেখতে চান। কিন্তু পুরো শহরটাই অপরিষ্কার, ময়লা-আবর্জনায় ভরা, রাস্তাঘাটও নাজুক। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।

প্রথম আলো: লবণশিল্প দাঁড়াতে পারছে না কেন?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: কক্সবাজারে বছরে সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়। অথচ চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফায়দা লুটে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। এখানে লবণ পরিশোধনের কারখানা থাকলেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়োডিনযুক্ত প্যাকেটজাত লবণ তৈরির কারখানা নেই। তাই লবণ চলে যাচ্ছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলোতে। সেখানে আয়োডিনযুক্ত করে প্যাকেটজাত লবণ বাজারে ছাড়া হয়। ওই লবণ কেজি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ কক্সবাজারের চাষিরা কেজিপ্রতি পান মাত্র তিন-চার টাকা। সে জন্য কক্সবাজারে আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে চাষিরা লাভবান হতেন। 

প্রথম আলো: কক্সবাজারে প্রতি মৌসুমে ৩০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হয়। কিন্তু শুঁটকি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই কেন?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: শুঁটকির মতো সামুদ্রিক মৎস্য সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। চেম্বারের পক্ষ থেকে সার ও কীটনাশক ছাড়া বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু সংস্থা থেকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। ইতিমধ্যে বহু শুঁটকি ব্যবসায়ী ও শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো: আবাসন খাতের সম্ভাবনা কেমন?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: এখানকার আবাসন খাতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব থাকায় মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাই ব্যবসায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো: বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের ৯৮ শতাংশ এলাকাই অরক্ষিত। অরক্ষিত সৈকতের উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কি আকৃষ্ট করা যায়?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: কক্সবাজারে এখন সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার ৬৯টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে রেললাইন, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ পর্যটনপল্লি, আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর প্রকল্প অন্যতম। বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত করতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেবে। এ ছাড়া

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবেশবান্ধব রেস্তোরাঁ ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। 

প্রথম আলো: বিসিক শিল্পনগরের বেহাল অবস্থা কেন?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: চিংড়ি উৎপাদন কমে যাওয়ায় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিসিকে অবকাঠামোগত উন্নয়নও তেমন নেই।

প্রথম আলো: বলা হয় মাদক পাচারের নিরাপদ রুট কক্সবাজার। মাদকের কালোটাকা কি বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে না?

আবু মোর্শেদ চৌধুরী: অবশ্যই প্রভাব ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এনবিআরকে নজরদারি বাড়াতে হবে। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য দেখাতে ব্যর্থ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে টেকনাফের ১০২ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও এখনো অনেকে মাঠে রয়ে গেছে। ইয়াবার মূল গডফাদার কারা, তা শনাক্ত না হলে কালোটাকার ব্যবহার রোধ করা কঠিন।