এখানেও সেই জগৎ শেঠ

জগৎ শেঠ
জগৎ শেঠ

ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি, অর্থনীতির সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, শ্রম বিভাজন, সরকারের নানা প্রয়োজন, নিত্যনতুন নগর গড়ে ওঠা ও সরকারের নানা প্রয়োজনীয়তার কারণে প্রাচীনকালের পণ্য বিনিময় প্রথা ভেঙে যায়। লেনদেনের সনাতনী এই পদ্ধতির জায়গায় প্রচলন ঘটে মুদ্রা ব্যবস্থার।

এই উপমহাদেশে বিশেষ করে মোগল আমলে উল্লেখযোগ্য হারে মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যেসব অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু হয় তার অন্যতম একটি হলো ঢাকা। বস্ত্রশিল্পভিত্তিক রপ্তানি বাণিজ্যে উৎকর্ষের সুবাদেই মূলত ঢাকায় মুদ্রা প্রচলন অনিবার্য হয় পড়ে। উপমহাদেশজুড়ে রাজস্ব আদায়ে গ্রহণযোগ্য মুদ্রা হিসেবে চালু হয় সিক্কা রুপি। তবে জেলা বা অঞ্চলভিত্তিক মুদ্রাও ছিল প্রচুর। যেমন বাংলায় ৫২ ধরনের মুদ্রার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে ঢাকায় ছিল আর্কট মুদ্রার ব্যবহার।

বলে রাখা ভালো, মরক্কোর প্রখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, চতুর্দশ শতকে বাংলা সালতানাতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল।

যা-ই হোক, ১৭৫৭ সালের পরে মোগলদের মুদ্রা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চালু হয় নানা মূল্যমানের মুদ্রা। ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব মুদ্রা বাংলায় আসে। দেশীয় রাজা, ব্যাংকার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন টাঁকশাল থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা তৈরি করিয়ে নেন। আবার সব ইউরোপীয় কোম্পানিও নিজেদের নামে মুদ্রা প্রচলন করে। বাংলায় আঞ্চলিক পর্যায়েও বিভিন্ন নামে মুদ্রা চালু হয়। এতে অবশ্য মুদ্রাবাজার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। 

একইভাবে ঢাকার মুদ্রাবাজারে বিভিন্ন ধরনের আর্কট রুপির প্রচলন ঘটে। এসব আর্কট মুদ্রার মধ্যে ফ্রেঞ্চ আর্কট, ইংলিশ আর্কট, ডাচ আর্কট, মুসুলিপট্টম আর্কট, বিস সানু আর্কট, ফার্সি আর্কট, শাহরদার আর্কট, মাদ্রাজ আর্কট, সুরাট আর্কট, বেনারস আর্কট, দিল্লি আর্কট ছিল অন্যতম।

১৭৮৭ সালে প্রকাশিত ঢাকার কালেক্টর ম্যাথিউ ডে এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ঢাকা প্রদেশের প্রধান মুদ্রা হলো আর্কট। এ মুদ্রায় সব বাণিজ্যিক লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। তালুকদার ও রায়তদের কাছ থেকে জমিদারেরাও এই মুদ্রায় খাজনা আদায় করে। মফস্বলেও এ মুদ্রার প্রচলন লক্ষ করা যায়। 

ঢাকার আর্কট মুদ্রা বেশ শক্তিশালী ছিল বলে জানা যায়। তখন ঢাকাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি আর্কট রুপি। তখনো একক কোনো মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। উনিশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত ডাকসাইটে ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী বণিকদের হাতেই ছিল ঢাকার মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রণ। 

ঐতিহাসিক তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনায় জানা যায়, ঢাকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা তথা মুদ্রাবাজার ছিল কয়েকটি সরফ বা অর্থলগ্নিকারী হাউসের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হাউসের মালিককে পাঠকসমাজ খুব সহজেই চিনবেন। তিনি হলেন জগৎ শেঠ। যাঁরা নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা বা যাত্রাপালা দেখেছেন, তাঁরা জটিল ও কুটিল চরিত্রের এই লোকটির নাম জানেন (যদিও ইতিহাস আর যাত্রা-সিনেমায় পার্থক্য থাকে)। ঢাকার প্রভাবশালী অন্য বৃহৎ হাউসগুলোর মধ্যে আরও ছিল সাতুরমুরা খান, রামদুলাল বোস, বলরাম দেব, গোপাল দাস, কৃষ্ণ চরণ দাস, শিবনাথ দাস, মনোহর দাস, শিবপ্রসাদ ও কিশোর দাস। এসব সরফ বা অর্থলগ্নিকারী হাউসের বেশির ভাগেরই মালিক ছিলেন ঢাকায় বসবাসরত অবাঙালি। তখন সরফদের এতটাই প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল যে অনেক সময় সরকারও মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। 

১৭৬৫ সাল পর্যন্ত জগৎ শেঠ পরিবার ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানকার মুদ্রাব্যবস্থা তথা ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ইংল্যান্ডে মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড যে ভূমিকা রাখত ‘হাউস অব জগৎ শেঠ’ বাংলায় একই কাজ করত। তবে আঠারো শতকের শেষ দিকে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব শেষ হয়ে যায়। তখন দাপট শুরু হয় হাউস অব মথুরা সেনের। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার কারণে তারা বেশি দিন টেকেনি। এই সুযোগে শত শত সরফের আবির্ভাব ঘটে। 

এদিকে ঢাকার মুদ্রাবাজারের অর্থবহ নিয়ন্ত্রণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার পদক্ষেপ নেয়। তারা প্রথমেই জগৎ শেঠ পরিবারের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব করে। এ জন্য তারা ওই পরিবারের সদস্য অগত শেঠ কাথের বিরুদ্ধে জয় কৃষাণ নামে আরেক লগ্নিকারীকে দাঁড় করায়।

এরই মধ্যে ১৮২০-৩০ সালের মধ্যে বাংলায় ইউরোপীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়। এতে দেশীয় ব্যাংকিং হাউস ও সরফদের নিয়ন্ত্রিত মুদ্রাবাজার নতুন ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে ১৮৩০ সালের মধ্যে তাদের বিলুপ্তি ঘটে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ধাঁচে চালু হওয়া আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও আস্থার সংকট তৈরি হয়। কারণ, ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল এবং নীল চাষ ও নীলকরদের দেওয়া অর্থ ঝুঁকিতে পড়েছিল। এতে তারা দেউলিয়া হতে শুরু করে। 

১৮৩৬ সালে পুরোনো মুদ্রা বিলুপ্ত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন মুদ্রা চালু করে। এই মুদ্রার একক ছিল রুপি, আনা ও পাই। 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পরে চালু হয় পাকিস্তানি রুপি। অতঃপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর পরে ১৯৭২ সালে টাকার অভিযাত্রা শুরু হয়। টাকা অবশ্য ঢাকার নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মুদ্রা। 

সূত্র: ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস