তেল-চিনিতেও বাড়ল ব্যয়

এ যেন মড়ার ওপর নতুন ঘা। বাজারে সীমিত আয়ের মানুষের বাড়তি খরচের মধ্যে নতুন করে বাড়ল ভোজ্যতেল ও চিনির দাম।

কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়েছে। সঙ্গে প্যাকেটজাত চিনির দাম বাড়ানো হলো কেজিতে ৭ টাকা।

ভাবছেন, বোতলের তেল আর প্যাকেট চিনি বাদ দিয়ে খোলা পণ্য কিনবেন? তাহলে আপনার জন্য আরও দুঃসংবাদ। গত এক মাসে বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দামও লিটারপ্রতি ৮ টাকা ও পাম সুপার তেলের দাম ১৬ টাকার মতো বেড়েছে। গত জুনে বাজেট ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত খোলা চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ১২ টাকার মতো।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এই দুটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বাজেটে নতুন করে কর আরোপ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই দাম বাড়ানো হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য আজ রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বৈঠক ডেকেছে। কিন্তু এরই মধ্যে বাজারে এই দুটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

তিন কোম্পানির তিনজন পরিবেশক জানিয়েছেন, ১ লিটারের বোতলে তেলের দাম বেড়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। ১০২ থেকে ১০৩ টাকার এক বোতল সয়াবিন তেল এখন ১১০ টাকায় কিনতে হবে।

পাঁচ লিটারের বোতলে বেড়েছে প্রতি লিটার ৪ থেকে ৬ টাকা। ফলে তিনটি কোম্পানির ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল কিনতে মানুষের খরচ পড়বে ৫৩০ টাকা (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপি), যা এর আগে ৫০০ টাকা ছিল। একটি কোম্পানির দাম আরেকটু বেশি—৫৫০ টাকা।

বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে গত দেড় থেকে দুই মাসে। এরও আগে দাম বেশ কম ছিল। তখন কিন্তু সুফল পায়নি সাধারণ ভোক্তারা। কোম্পানিগুলো মোড়কে লেখা মূল্য কমায়নি। এর বদলে খুচরা ব্যবসায়ীদের ছাড় দিয়ে তেল বিক্রি করেছে তারা। ফলে ১ লিটার তেলে ৮ থেকে ১০ টাকা মুনাফা করার সুযোগ পেয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। এখন বিশ্ববাজারে দাম যখন বাড়ল, তখন নেতিবাচক প্রভাবটি ক্রেতাদের ওপরই পড়ল।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিল গড়ে প্রতি টন ৭৪০ ডলার। নভেম্বর মাসে গড় দাম ৭৭৫ ডলারে উন্নীত হয়। গত কয়েক মাসে ডলারের দামও কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ হারে এক স্তরের বদলে তিন স্তরে আরোপ করা হয়। এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলে প্রতি লিটারে কর পড়ছে প্রায় ২০ টাকা।

এ ছাড়া বাজেটে অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি আমদানি শুল্ক ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়। আবার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখন চিনির ওপর কেজিতে ২২ থেকে ২৩ টাকা কর পড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

বাজারে এখন এক কেজির খোলা চিনির দাম ৬২ থেকে ৬৬ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও যা ৬০ টাকা ছিল। গত জুন মাসে বাজেট ঘোষণার আগে চিনির দাম ছিল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। সে হিসেবে সাত মাসে খোলা চিনির দাম বাড়ল কেজিতে ১২ টাকার মতো।

ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দাম না বাড়িয়ে আর উপায় ছিল না।

তেল–চিনির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে। আবার খাদ্যের খরচ বাড়লে তা বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেয়।

পরিবারের রান্না ও নিজের ছোট একটি খাবার বিক্রির ব্যবসার জন্য রাজধানীর তালতলা বাজারে পাম সুপার তেল কিনতে গিয়েছিলেন সেলিনা বেগম। তিনি বলেন, মাসখানেক আগেও ১ কেজি তেল তিনি ৬৮ টাকা দরে কিনতে পারতেন। এখন সেটা ৮২ টাকা নিচ্ছেন দোকানি।

সেলিনা বেগম বলেন, ‘চাল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, তখন খাবারের দাম বাড়াইনি। এবার তেলের দামও বাড়ল। এখন আর না বাড়িয়ে পারা যাবে না।’

সেলিনা দাম বাড়ালে খরচ বেড়ে যাবে ওই সব রিকশাচালকের মতো মানুষের, যাঁরা দিনে ১১০ টাকার বিনিময়ে সেলিনার গ্যারেজে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পান। রিকশাচালকদের ব্যয় বাড়লে তাঁরাও বাড়তি ভাড়া নেবেন, যা পরোক্ষভাবে ব্যয় বাড়াবে সাধারণ মানুষের।

এ বছর মানুষকে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ২৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে। যদিও এখন কমেছে, তবু দেশি পেঁয়াজের দর কিন্তু ১১০ থেকে ১২০ টাকা। সরু চাল ৪৪ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি হয়েছে। সরু মসুর ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। ময়দার দাম কেজিতে ৮ টাকা বেড়ে ৪০ টাকা ছাড়িয়েছে।

জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এসব পণ্য না কিনে কোনোভাবেই পারা যায় না। মূল্যবৃদ্ধি হলে ধনীদের ওপর নয়, প্রভাব পড়ে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। তারা নানাভাবে খরচ কমিয়ে এই মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় করার চেষ্টা করে। এতে তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য কমে যায়।