অর্থনীতির যত কাণ্ডকারখানা

পেঁয়াজের দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে কি না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ছবি: প্রথম আলো
পেঁয়াজের দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে কি না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ছবি: প্রথম আলো

এ বছর, মানে ২০১৯ সালে এ নিয়ে কয়টা কাণ্ড ঘটল। এই ধরেন, ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ২৫০ টাকায় ওঠার মতো। মাথা চুলকে হিসাব মিলছে না। মনে করিয়ে দিই, লবণ কেনার হুজুগে কি শামিল হয়েছিলেন? পবিত্র ঈদুল আজহার দিন গরুর চামড়াটি কি বিক্রি করতে পেরেছিলেন?

আপনি ব্যবসায়ী হলে আরেকটি কাণ্ডের কথা কিন্তু আপনার মনে থাকার কথা, সুদের হার নয়-ছয় নিয়ে বছরজুড়েই তো নানা কাণ্ড ঘটল। শেষে সুদের হার বেঁধেই দিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যদিও শুধু উৎপাদনশীল খাতে।

শুধু বাজারের নয়, পেঁয়াজ এ বছর সব মিলিয়েই আলোচিত চরিত্রের একটি। দেশি পেঁয়াজের ঝাঁজ বেশি। দামের ঝাঁজ কতটা হতে পারে, তা এ বছর টের পেয়েছেন সবাই। বছরের শুরুতে দেশবাসী ২৫ থেকে ৩৫ টাকা কেজির মধ্যে পেঁয়াজ কিনেছেন। বছরের শেষ প্রান্তিকে দেশি পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা দরেও।

পেঁয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হচ্ছে ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপরই দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়তে থাকে। এরপর পেঁয়াজ উড়োজাহাজে উড়ে আসে, জাহাজে ভেসে আসে। চোরাপথে ভারত থেকেও যে কিছু আসেনি, সে কথাও বলা যায়। ডিসেম্বরের শুরুতে দেশি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করে।

মধ্যে বিস্তর কথা হয়, অভিযান হয়, জরিমানা হয়, কারাদণ্ড হয়। তিন মাস পরেও দেশি পেঁয়াজ কিন্তু কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা গত বছর এ সময় ৩৫ টাকার মধ্যে ছিল।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি আগেও বন্ধ করেছিল। যেমন, ২০১০ সাল ও ২০১১ সাল। তখন কিন্তু দাম দ্বিশতক ছাড়ায়নি। পেঁয়াজের দামে এর আগের রেকর্ড হয় ২০১৭ সালে। ওই বছর ডিসেম্বরে দেশে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ১৪০ টাকা দরে। এবার মিসর, চীন ও তুরস্কের বড় বড় পেঁয়াজই ১৮০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়।

পেঁয়াজসংকটে অনেকেই উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন, অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলেছে, উৎপাদন ১৮ লাখ টনের মতো। এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলার তালিকায় ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলমও। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গরমিলকে জায়েজ করেছিল পচে যাওয়ার হিসাব দিয়ে। তাদের মতে, ২৫ শতাংশের মতো পচে যায়, এটা বিবেচনায় নিলে পেঁয়াজের উৎপাদন ১৮ লাখ টনের মতোই দাঁড়ায়। 

সরকারের কেউ কেউ পেঁয়াজের কারসাজি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুত করেছেন। যদিও এখনো সেই মজুত বের হয়নি। বাজারে পুরোনো দেশি পেঁয়াজও নেই। 

অবশ্য নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি পেঁয়াজের বিপদ নিয়ে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। যেমনটি বলেছিলেন চামড়ার ক্ষেত্রেও। 

দেশে গত আগস্ট মাসে পবিত্র ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে বরাবরের মতোই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে চামড়ার দাম ঠিক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ঈদুল আজহার দিন ও পরে দেখা গেল, চামড়া কেনার লোক কম। অনেক জায়গায় পানির দরে চামড়া বিক্রি করলেন কোরবানিদাতারা, অনেক জায়গায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হলো, অনেক জায়গায় চামড়া পচে গেল। কত চামড়া পচে গেল, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। 

২৮ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চামড়া নিয়ে এবার আমার শিক্ষা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হবে না।’ 

লবণ নিয়ে যা হলো তাকে কাণ্ড না বলে কোনো উপায় নেই। ১৮ নভেম্বর সিলেটে লবণসংকটের গুজব শুরু হয়। পরদিন তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কোথায় লবণ ১০০ টাকা কেজি হয়ে গেছে, কোথায় ১৫০ টাকা ছাড়িয়েছে, সেই খবর বলতে বলতে মানুষ ছুটেছে বাজারে। কেউ কেউ সারা বছরের লবণ একসঙ্গে কিনে বাড়ি ফিরেছেন। অবশ্য লবণের গুজব টেকেনি। কারণ, যথেষ্ট লবণ ছিল। পেঁয়াজের সংকট কিন্তু দুই দিনে কাটেনি। 

ব্যাংকঋণের সুদের হার নিয়ে নানা কাণ্ড হয়েছে বছরজুড়ে। যার শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ওই বছর জানুয়ারিতে ব্যাংকমালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে সরকার, যাতে একই পরিবার থেকে চারজনের পরিচালক হিসেবে টানা ৯ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ তৈরি হয়। 

এরপরই ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে আমানত ও সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয় ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। তবে সেটা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ব্যাংকমালিকেরা গত দেড় বছরে কর কমানো, সরকারি সংস্থার আমানত পাওয়া, আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমায় ছাড়সহ নানা সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু সুদহার আর কমেনি। বরং বেড়েছে। অবশেষে সরকারের চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। 

ফলে জানুয়ারিতেই বোঝা যাবে, সুদ নিয়ে আর কী কাণ্ড অপেক্ষা করছে।

পেঁয়াজ–কাণ্ড
৪০ টাকার পেঁয়াজ ২৫০ টাকা। নানাজনের নানা কথা, অভিযান, জরিমানা, উড়িয়ে আনা, পেঁয়াজের দাম এখনো চড়া। বাণিজ্যমন্ত্রীর শিক্ষালাভ। 

চামড়া–কাণ্ড
পচল, মাটিতে পুঁতে ফেলা হলো, পানির দরে বিক্রি হলো, নষ্ট হওয়ার সংখ্যা বিতর্ক নিয়ে হলো। বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, শিক্ষা পেয়েছি। 

লবণ–কাণ্ড
কেজি ১০০ টাকা হওয়ার গুজবে কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল মানুষ। কেউ কেউ সারা বছরের চাহিদার লবণ একসঙ্গে কিনে নিলেন। এক দিন পরই হুজুগের বিদায়। 

সুদ–কাণ্ড
২০১৮-তে ব্যাংকমালিকদের বিস্তর সুবিধা। ২০১৯ গেল সুদের হার কমার আশায়। বছর শেষের সাত দিন আগে সিদ্ধান্ত হলো, উৎপাদনশীল খাতে সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হবে।