ঋণ পুনঃ তফসিলে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংকের ঋণ মন্দ হয়ে পড়লে কীভাবে পুনঃ তফসিল করা যাবে, এ নিয়ে ২০১২ সালে হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঋণ নিয়মিত করতে পারে। কিন্তু ওই নীতিমালার বাইরে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নিয়মিত করার অনুমোদন দেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই বিশেষ বিবেচনার সিদ্ধান্ত এখন হিতে বিপরীত হয়েছে।

প্রতিদিন ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃ তফসিলের শতাধিক ফাইল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজে গিয়ে তদবির করছেন, আবার ওপর মহল থেকেও তদবির করাচ্ছেন। যাঁর তদবির যত শক্তিশালী হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ তাঁকে সেভাবেই সুবিধা দিচ্ছে। নীতিমালার বাইরে এসব ঋণ পুনঃ তফসিলের দায় কোনো কর্মকর্তা নিতে চাইছেন না, ফলে প্রতিটি ফাইলে গভর্নরের অনুমোদন লাগছে। এর ফলে ব্যাংকিং নীতি বিভাগটি হয়ে পড়েছে পুরোপুরি ঋণ পুনঃ তফসিল বিভাগ। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন ঋণ পুনঃ তফসিল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ব্যাংক খাতের নিয়মিত বিষয়ের পরিচালনায় (অপারেশন) বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ভূমিকাকে ভালোভাবে দেখছেন না অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা দেবে, ব্যাংকগুলো তা মেনে চলবে। তবে এখন উল্টোটা হচ্ছে। ঋণ পুনঃ তফসিল করছে, পরে সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ দিয়ে আর্থিক স্থিতিপত্র অনুমোদন দিচ্ছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণের থেকে পরিচালনার ভূমিকায় বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে করপোরেট সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটছে।’

চলতি মাসের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ প্রতিবেদক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকদের কাছে যাওয়া বেশ কিছু ফাইল পর্যালোচনা করেছেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাওয়া ব্যবসায়ী, সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকার, রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগের উদ্দেশ্য ছিল ঋণ পুনঃ তফসিলের তদবির বা খোঁজখবর নেওয়া।

>

শতাধিক ফাইল প্রতিদিন জমা হচ্ছে। সুবিধা পেতে ব্যবসায়ীরা নিজেরা তদবির করছেন, আবার ওপর মহল থেকেও তদবির করাচ্ছেন।

শুধু ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের সব কর্মকর্তার কাছেই এখন তদবির আসছে। যে যেভাবে পারছেন, বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃ তফসিলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আবার অনেক কর্মকর্তা এটাকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। কোনো কোনো গ্রাহককে ঋণ নিয়মিত করার জন্য ৫ শতাংশ টাকা এককালীন জমা দিতে হচ্ছে, আবার কাউকে ১০ শতাংশ। আবার কেউ সুদ হার পাচ্ছে ৯ শতাংশ, কেউবা আরও বেশি। অন্যদিকে কোনো কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধে এক বছরের বেশি সময় বিরতি পাচ্ছে, আবার কেউ ছয় মাসও সময় পাচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত করলে সুবিধা বেশি, তাই সবাই সেদিকেই ছুটছেন।

জানা গেছে, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগটি আগে নীতি প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এখন পুরোপুরি পুনঃ তফসিল নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিদিন এ–সংক্রান্ত শত শত ফাইল বিভাগটিতে জমা হচ্ছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ঋণ পুনঃ তফসিল–সংক্রান্ত ২০টির বেশি ফাইল অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল হয়েছে। বছর শেষে তা ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ ২০১৮ সালের পুরো বছরে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল, ২০১৭ সালে যা ছিল ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

এমন ব্যবস্থাকে খুব ভালোভাবে দেখছেন না এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। গত মাসে অবসরে যাওয়া সাবেক এ ব্যাংকার বলেন, ‘নীতিমালার মধ্যে যেসব ঋণ পুনঃ তফসিল করা যায়, ব্যাংকগুলো তা নিজেরাই করে ফেলছে। বাকি গ্রাহকেরা নিজেরাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে আসছেন। গ্রাহকের চাপে ব্যাংকগুলো চিঠি দিচ্ছে। সরকার গ্রাহকদের ব্যাপারে নমনীয়। তাই এমনটা চলছে। তবে সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে থাকলে ভালো হতো।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা নীতিমালার মধ্যে ঋণ নিয়মিত করতে পারছেন না, তাঁরাই আমাদের কাছে আসছেন। এভাবে কত দিন চলবে, তার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নিশ্চয়ই একদিন সিদ্ধান্ত আসবে।’