এপ্রিলে কার্যকর এক অঙ্কের সুদহার

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর। ছবি: সংগৃহীত
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর। ছবি: সংগৃহীত

নতুন বছরের এপ্রিল মাস থেকে সব ঋণের ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের ঘোষণা এসেছে। আর সাধারণ জনগণের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো কাউকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেবে না বলে জানানো হয়েছে। তবে ক্রেডিট কার্ডে সুদহার বেশি হবে। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে আগামী ১ এপ্রিল থেকে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানের বিএবি কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এর আগে ১ জানুয়ারি থেকে উৎপাদন খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে এ সুদ কার্যকর হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করতেই হবে। এতে আর কেউ আপত্তি করেনি। একজন এমডি রিটেইল ও ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বেশি সুদের যুক্তি তুলে ধরে তোপের মুখে পড়েন। পরে আর কেউ মুখ খোলেননি। সভা শেষে কয়েকজন চেয়ারম্যান ও এমডিকে ‘মন খারাপ’ করে বের হতে দেখা যায়। তবে কেউ কথাও বলতে চাননি।

সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা কথা দিয়েছিলাম ১ জানুয়ারি থেকে ৬-৯ সুদহার বাস্তবায়ন করব। আজ পর্যন্ত আমরা সেই সার্কুলার দিতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনার আলোকে সব হবে। আমরা প্রথমে যেভাবে সার্কুলার করতে চেয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী তা রেখেছেন। সঙ্গে কিছু সংশোধন করেছেন। সেই সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে কিছু সময় লাগবে।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এটা জানুয়ারির পরিবর্তে ১ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন করতে চায়। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুই মাসের সময় নিয়ে এসেছিলাম। ব্যাংকগুলো তিন মাসের জন্য যেসব আমানত নিয়েছিল, এর মধ্যে তার মেয়াদ শেষ হবে। না হলে অসামঞ্জস্য তৈরি হবে। এতে ব্যাংকগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে।’

মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আগে জানতেন, ৯ শতাংশ সুদ শুধু উৎপাদন খাতে কার্যকর হবে। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে। নতুন ও পুরোনো সব ধরনের ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাহিদা।’

এমন সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো কোনো শর্ত দিয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো শর্ত দেয়নি। আমরাই বলেছি, সরকারের যে কম সুদের তহবিল আছে, তার অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংক পাবে। সরকারি ব্যাংকগুলো অর্ধেক পাবে।’

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো সাড়ে ৫ শতাংশ সুদে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ সুদে সরকারি আমানত নেবে। ফলে প্রতিযোগিতা ভালো। পরিশোধিত মূলধনের ভিত্তিতে সরকারি আমানত বরাদ্দ পাবে।

এপ্রিল থেকে সুদহার কার্যকরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হবে ৯ ও আমানতের ৬ শতাংশ। এর বেশি কেউ অফার করতে পারবে না। ব্যক্তি ও সরকারি তহবিল নিতে এর চেয়ে বেশি সুদ কেউ দিতে পারবে না। আর ৯ শতাংশ কার্যকর হলে সরল সুদ আর লাগবে না। সব সমান হয়ে যাবে।

যেসব ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী আমানত নিয়েছে, তারা কোনো লোকসানে পড়বে কি না, জানতে চাইলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘লোকসান তো হবেই। এ জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হচ্ছে। তিন মাস পর আমরা কোনো কথা শুনব না। ৬ ও ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন হবেই।’

পরে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘রোববার রাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও আমাকে ডেকেছিলেন। তিনি বলেছেন, শুধু উৎপাদন বা শিল্পকারখানা নয়, সব ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও এর নিচে হতে হবে। এ জন্য আমরা কয়েক দিন সময় পেয়েছি। দেশের জনগণ ও অর্থনীতির স্বার্থে এপ্রিল থেকে আমানতে ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে।’

২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে এই সুদহার কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়িত হয়নি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘তখনকার বলা আর এখনকার বলা এক নয়। তখন আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলাম। কিন্তু যেভাবে সরকারি সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, আমরা সেভাবে পাইনি। বিভিন্ন করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক থেকে আমরা আমানত পাইনি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী যেভাবে বিষয়টি নিয়েছেন, আঁকড়ে ধরেছেন—এবার এ সিদ্ধান্ত আর ব্যর্থ হবে না। এবার ব্যর্থ হলে আমরা মনে করব, পুরো অর্থনীতি ভেঙে গেছে।’

এ জন্য কোনো বাড়তি সুবিধা লাগবে কি না, জানতে চাইলে পাশে থেকে অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনাদের (সাংবাদিকদের) সহযোগিতা লাগবে। এ সিদ্ধান্তকে ভালো বলতে হবে। আর নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এই সুদহার কার্যকর করতে বাড়তি কোনো সুবিধা লাগবে না।

তবে ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাঁরা বলেন, সরকারের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করলে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। আবার ব্যাংকভেদে আমানতের সুদহার সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ। হঠাৎ করে এটা কমানো হলে আমানত পাওয়া যাবে না। কারণ, সঞ্চয়পত্রে সুদ এখনো ১০ শতাংশের বেশি।

সূত্রমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকমালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে সরকার, যাতে একই পরিবার থেকে চারজনের পরিচালক হিসেবে টানা ৯ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ তৈরি হয়। এরপরই ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে আমানত ও সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয় ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। তবে সেটা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ব্যাংকমালিকেরা গত দেড় বছরে আরও অনেক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু সুদহার আর কমেনি।