সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধির পথে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর সর্বনিম্ন। বাণিজ্যযুদ্ধই এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এর পাশাপাশি কাঠামোগত সংকটও এই শ্লথগতির অন্যতম কারণ বলে মানছেন অর্থনীতিবিদেরা।

২০১৮ সালে চীনের বিপুল পরিমাণ পণ্যে শুল্ক আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যবিরোধ চলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পরস্পরের পণ্যে শুল্ক আরোপ করছে। এসব বাণিজ্য-বাধার জেরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। ২০১৯ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে দুই দেশের প্রবৃদ্ধির হার কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশেষত চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক দেশের রপ্তানি কমে গেছে।

এদিকে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) বলছে, শুধু বাণিজ্যযুদ্ধ বা উচ্চ শুল্ক নয়, এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কার। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের গতি কমে যাচ্ছে তা ঠিক, কিন্তু চ্যালেঞ্জের কথা বললে জলবায়ু ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন অনেক বড়। আর বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসছে, বাণিজ্যযুদ্ধ তারই অংশ।

এদিকে বিশ্ববাণিজ্য এই মুহূর্তে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সংস্থাটির সদস্যদেশগুলো ১০২টি নতুন বাণিজ্য-বাধা আরোপ করেছে, পরিমাণের দিক দিয়ে যা ৭৪ হাজার ৬৯০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ায় প্রবৃদ্ধি কমছে। কিন্তু ব্রেক্সিটজনিত অনিশ্চয়তার কারণে যে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে, তা কাঠামোগত সমস্যা। ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন নিয়ে অচলাবস্থার নিরসন হয়েছে। এখন ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে যেতে হবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। কমেছে রাজস্ব। বেকারত্ব বাড়লেও মুকেশ আম্বানির সম্পদ বাড়ছে। জিএসটি ও বড় নোট বাতিলের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মার খাচ্ছে। ফলে সমস্যাটা কাঠামোগত।

বাংলাদেশের রপ্তানিও সম্প্রতি কমতে শুরু করেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ এর একটি কারণ, কিন্তু রপ্তানির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় তৈরি পোশাক খাতনির্ভরতা কাল হয়ে উঠছে। রাজস্ব কমছে আর বড় বড় প্রকল্পের জন্য সরকার ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিচ্ছে। এই পরিস্থিতির উত্তরণে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা।

২০১৯ সালের বড় সময়জুড়ে নতুন বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। অনেকেই বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি একধরনের মন্দার কবলেই আছে। চাহিদা ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা এসব কথা বলছেন।

এই পরিস্থিতিতে নীতিগত সংস্কারে জোর দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একধরনের জড়তা আছে। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লাগার্দ ২০১৭ সালে যা বলেছিলেন তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়—‘রোদ থাকতে থাকতে চালের ফুটো সারানো দরকার।’