ঋণখেলাপি ও ব্যাংকগুলোকেই ছাড়

বিদায়ী ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় বারবার আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে বিশেষ করে ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দিয়েও তার লাগাম টানতে না পারা, ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ প্রদান, ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ছাড়, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন এবং খেলাপিদের ঋণ পুনঃ তফসিলকরণের সুযোগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্বাভাবিক তৎপরতা দফায় দফায় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

ব্যাংক খাত থেকে একদিকে উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়া, অন্যদিকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে উদ্বেগ বেড়েছে। 

এই খাতে কেমন গেল পুরো বছর—এমন প্রশ্ন করা হলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। ঋণ পুনঃ তফসিলও বেশি হয়েছে। বলা যায়, বছরজুড়ে আর্থিক খাত দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল। এই অবস্থায় ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়ায় প্রতিটি ব্যাংকের আয় ১৫০ কোটি টাকার মতো কমে যাবে। আশা করি, নতুন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি সক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন আরও বাড়বে।’

খেলাপি ঋণ
নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বছরের শুরুর দিকে ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু এই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে দেশে খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। তা পরের তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল-জুনে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বরে আরও ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বেড়েছে। সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

খেলাপিদের যত সুবিধা
বিদায়ী বছরে ঋণখেলাপিদের বড় সুবিধা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে সুদহার ধরা হয় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর ঋণ পরিশোধে এক বছরের বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করা যাবে। আবার তাঁরা নতুন ঋণও নিতে পারবেন। এ সুবিধার আওতায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রয়েছে। 

সুদহার নয়–ছয়
ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ এবং ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়ে দেড় বছর ধরে অনেক সুবিধা নেয়। যেমন সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমানো হয়। অথচ তাঁরা সুদহার কমাননি। অবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরের শেষ দিকে এসে উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দেয়, যা নতুন বছরের শুরু থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

বেসরকারি ঋণে মন্দা
২০১৯ সালে প্রতি মাসেই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। গত নভেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমেছে, যা এর আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ০৫ শতাংশে। প্রবৃদ্ধির এই হার গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিকে বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, তা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। অথচ ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সোয়া পাঁচ মাসেই ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

আরও নতুন ব্যাংক
দেশের অর্থনীতির তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, এই আলোচনা দীর্ঘদিনের। এরপরও চলতি বছরে তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হলো বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। তবে কোনোটি এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। আর চলতি বছরে কার্যক্রম শুরু করে পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংক। 

পিপলস লিজিং অবসায়ন
গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে চাপে পড়েছে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না তারা।