সুদ কমানো ভালো উদ্যোগ, ঋণ যেন কমে না যায়

আবুল কাসেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
আবুল কাসেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
>

নয়-ছয় নিয়ে দেড় বছর পার করার পর এবার ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারির বদলে তা এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এটা টেকসই হবে কি না, প্রভাব কী হতে পারে, এটাই কি সমাধান হওয়া উচিত—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি এবং এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাসেম খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ

প্রথম আলো: ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। আপনি কী মনে করছেন?

আবুল কাসেম খান: দেশের বেসরকারি খাত একটা চাপের মধ্যে আছে। এর কারণ অনেকটা ব্যাংক খাতের সঙ্গে যুক্ত। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তাই সুদহার কমানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। সরকারের উদ্দেশ্য ভালো। কম সুদের কারণে ঋণের চাহিদা বাড়বে। এতে বেসরকারি খাত চাঙা হয়ে উঠবে। ব্যাংকের ঋণের সুদের হার যদি ৯ শতাংশ, আর আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ টেকসই হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর হবে না।

প্রথম আলো:সুদহার নির্ভর করে ব্যাংকের মোট তহবিল ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ডের ওপর। ব্যাংক আমানত পাবে কি না, সেটা নির্ভর করে আমানতের সুদের হারের ওপর এবং বাজারে কী বিকল্প আছে, তার ওপর। শুধু ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতের সুদের হার বেঁধে দিয়ে কি বিষয়টি টেকসই করা সম্ভব?

কাসেম খান: আমিও সেটা নিয়েই চিন্তিত। এটা কত দিন টেকসই হবে, ছয় মাস, নয় মাস? কয়েক বছর আগেও ঋণের সুদের হার বেশ কমে গিয়েছিল। আমানতের সুদের হারও কমে যায়। তখন ব্যাংকে তারল্য-সংকট তৈরি হয়। ফলে ব্যাংক আবার আমানতের সুদের হার বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়। আমার ভয় হলো, সুদ কমিয়ে দেওয়ার ফলে ক্রেডিট ক্রাঞ্চ (ঋণসংকট) তৈরি হয় কি না।

প্রথম আলো: সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি। আরও অনেক জায়গায় বাড়তি সুদে টাকা রাখা যায়। তাহলে ব্যাংকে মানুষ ৬ শতাংশ সুদে টাকা রাখবে কেন?

কাসেম খান: আমার মনে হয়, স্বল্প মেয়াদে ব্যাংকেই টাকা থাকবে। কারণ, সঞ্চয়পত্র কেনায় কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করাসহ কিছু পদক্ষেপ এসেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মধ্য মেয়াদে জমি, ফ্ল্যাট কেনাসহ টাকা বিভিন্ন খাতে যেতে পারে। আবার সরকার প্রচুর টাকা ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে চাপ তৈরি হতে পারে।

প্রথম আলো:তাহলে এভাবে সুদহার না বেঁধে দিয়ে ভালো সমাধান কী হতে পারত?

কাসেম খান:সেটা সবাই জানে। খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। যেসব মন্দ ঋণ আদায়যোগ্য, তা আদায় করতে হবে।

প্রথম আলো: একটা বিষয় হলো, কিছু বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার কম। কিন্তু সুদের হার সেখানেও বেশি। তাহলে সেটি কেন?

কাসেম খান:এর কারণ বেসরকারি ব্যাংকে মুনাফার চাপ বেশি থাকে। তাই তাদের ঋণ ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য (স্প্রেড) বেশি হয়। এবার তো ঋণ ও আমানতের সুদের হার বেঁধে দেওয়ার কথা হচ্ছে।

প্রথম আলো: ব্যাংকের সুদের হার কমানো নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তাহলে কি আমরা শিল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকনির্ভরই থাকব?

কাসেম খান:দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এর একটা উৎস হতে পারে শেয়ারবাজার। সেখানে তো তিন বছর মুনাফায় না থাকলে কোম্পানি নিবন্ধিত হতে পারে না। এ নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া দরকার। বিশ্বখ্যাত কয়েকটি নতুন কোম্পানি কিন্তু এখনো মুনাফার মুখ দেখেনি। কিন্তু তারা পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখে বিনিয়োগ করেছে। শেয়ারবাজারের জন্য নতুন কোম্পানির অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা আরও শক্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে নতুন কোম্পানি হলে বাজারে আসা যাবে না, এমন বিধান রাখা ঠিক হবে না। তাহলেই কেবল ঋণের জন্য ব্যাংকনির্ভরতা কাটতে পারে। কোন কালে কে টাকা হাতিয়েছে, সেই চিন্তায় পুরো ব্যবস্থাটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত হয়নি। মানুষ কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে কি না, সেটা মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। তবে কোম্পানির প্রস্তাব যাতে স্বচ্ছ হয়, সেটা দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভালো ভূমিকা নিতে হবে। সরকারকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিকেও নজর দিতে হবে।

প্রথম আলো:আপনারা তো বন্ড বাজার নিয়েও কথা বলতেন।

কাসেম খান:এ দেশে বন্ড বাজারটি উন্নত করা জরুরি। আমরা দেখি, উন্নত ও শক্তিশালী উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে পুঁজিবাজার বন্ড ও অন্যান্য বিকল্প উৎস (ঋণ ও মূলধন) ব্যবসা ও অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের ঘাটতি দূর করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে বন্ড বাজার কার্যত অনুপস্থিত। দেশে বন্ড বাজারের উন্নতির জন্য আইনি ও ব্যবস্থাগত পরিবর্তন দরকার। সঠিক আইনি ব্যবস্থা, সচেতনতা, প্রণোদনা ও ব্যবস্থাগত পরিবর্তন না হলে বিনিয়োগকারীরা বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। ঢাকা চেম্বার বন্ড বাজারের উন্নতির জন্য গভীর পর্যালোচনা করে মানসম্মত কিছু সুপারিশ সরকারের কাছে দিয়েছিল। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) লন্ডন স্টক মার্কেটে বাংলা বন্ড চালু করেছে। এটা আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক খবর। বাংলা বন্ড নিয়ে কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে।