আবার খটখট পাটকলগুলোয়

আশ্বাসে অনশন ভেঙে নতুন উদ্যমে আজ সকাল থেকেই কাজে ফিরেছে পাটকলশ্রমিকেরা। খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস থেকে তোলা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
আশ্বাসে অনশন ভেঙে নতুন উদ্যমে আজ সকাল থেকেই কাজে ফিরেছে পাটকলশ্রমিকেরা। খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস থেকে তোলা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

টানা ছয় দিন বন্ধের পর দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো শ্রমিকদের পদচারণে মুখর হয়েছে। আজ শনিবার সেই সকাল থেকেই খটখট শব্দে চলতে শুরু করেছে যন্ত্রগুলো। সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করেছেন শ্রমিকেরা।

খুলনার খালিশপুরে শিল্পাঞ্চলের পাটকলগুলোয় আজ সকাল ছয়টা থেকেই শুরু হয়েছে কাজ। তবে কাজের মধ্যেও দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না শ্রমিকদের। এই দুশ্চিন্তার কারণ মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে। কয়েকজন শ্রমিক এক জায়গায় হলেই ঘুরেফিরে আসছে ওই কথা। তবে শ্রমিকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এবার আশ্বাসের হয়তো মূল্য পাওয়া যাবে।

বেলা দুইটার দিকে ক্রিসেন্ট জুট মিলের সামনে এমনই এক জটলার মধ্য থেকে কথা হয় মো. জুয়েল নামের ওই মিলের এক শ্রমিকের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার হয়তো বিমুখ হতে হবে না। কারণ, পাটমন্ত্রী নিজেই কথা দিয়েছেন। তারপরও দেখা যাক, ১৬ জানুয়ারির পর কী হয়।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের মধ্যে গিয়ে দেখা যায়, মোটামুটি সব কটি তাঁতই চলছে। যন্ত্রের খটখট শব্দের মধ্যে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকেরা। তবে কাঁচা পাটের সংকটের কথা জানান তাঁরা। কাঁচা পাট না পেলে কয়েক দিনের মধ্যে ওই ব্যস্ততা কমে যাবে।

প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, শ্রমিকেরা বেশ আশা নিয়ে এবার কাজে যোগদান করেছেন। মিলের কর্মপরিবেশ ফিরে এসেছে। বন্ধের আগে কিছু কাঁচা পাট ছিল, সেগুলো দিয়েই উৎপাদন শুরু করেছেন শ্রমিকেরা। শ্রমিকেরা আশাবাদী, মজুরি কমিশন নিয়ে এবার আর তাঁদের হতাশ হতে হবে না। তবে তাঁদের মধ্যে সন্দেহ থেকে গেছে। আর কয়েক দিন না গেলে বোঝা যাবে না প্রকৃত অবস্থা।

প্লাটিনাম জুট মিলের প্রকল্পপ্রধান ও বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, ভোর থেকেই শ্রমিকেরা মিল চালু করেছেন। আপাতত শ্রমিকদের পরিস্থিতি ভালো। কিছু কিছু মাল বিক্রি হওয়ার পথে। আশা করা যায়, ওই মাল বিক্রি হয়ে গেলে শ্রমিকদের মজুরি ও কাঁচা পাট কেনা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না।

দ্বিতীয় দফায় গত ২৯ ডিসেম্বর দুপুর থেকে নিজ নিজ পাটকলের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শ্রমিকেরা। টানা পাঁচ দিন কর্মসূচি পালন করার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে ও গতকাল শুক্রবার ভোরে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি শেষে আজ শনিবার সকাল ছয়টা থেকে মিলে গিয়ে কাজ শুরু করেন। সকাল ১০টায় নিজ নিজ মিলগেটে সভা করে আন্দোলনের সফলতার কথা জানান শ্রমিকনেতারা।

আগামী ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলশ্রমিকদের মজুরি কমিশনের স্লিপ প্রদান করার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। ওই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের সিবিএ সাবেক সভাপতি মো. মুরাদ হোসেন বলেন, ‘১৫ দিনের মধ্যে মজুরি কমিশনের স্লিপ প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৬ জানুয়ারি আমাদের স্লিপ প্রদান করা হবে।’ শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।

খুলনা অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত মোট নয়টি পাটকল আছে। এর মধ্যে খুলনায় রয়েছে সাতটি ও যশোরে রয়েছে দুটি। খুলনায় থাকা পাটকলগুলো হলো ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল ও ইস্টার্ন জুট মিল। আর যশোরের দুটি জুট মিল হলো কার্পেটিং ও জেজেআই।

বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, আমরণ অনশনের সময় খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয় পাটকলের মধ্যে যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিল বাদে বাকি সাতটি পাটকলের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এ পাটকলগুলোয় প্রতিদিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭২ মেট্রিক টনের বেশি। সেখানে চালু থাকা ওই দুটি পাটকলে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮৬ দশমিক ৩৯ মেট্রিক টন। পাটকলগুলোয় প্রতিদিনের উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। সে হিসাবে শ্রমিকদের পাঁচ দিনের অনশনে পাঁচ কোটি টাকার মতো উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে।

বিজেএমসি খুলনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী বনিজ উদ্দিন মিয়া বলেন, সব মিলের উৎপাদন শুরু হয়েছে। শ্রমিকেরা বেশ উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।

সরকারের আশ্বাসে আজ কাজে ফিরেছেন রাজশাহী জুট মিলের শ্রমিকেরা। গত শুক্রবার রাত ১০টায় তাঁরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন বলে জানান রাজশাহী জুট মিলের সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জিল্লুর রহমান।

গত রোববার থেকে ১১ দফা দাবিতে রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভায় রাষ্ট্রায়ত্ত রাজশাহী জুট মিলের প্রধান ফটকে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় দফার এ আন্দোলনে সাতজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

রাজশাহী জুট মিলের সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সরকারের আশ্বাসে তাঁরা আন্দোলন তুলে নেন। পরে এ মিলের নিয়ম অনুযায়ী গতকাল রাত ১০টায় তাঁরা কাজে ফেরেন। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকেরা সরকারের এ সিদ্ধান্তে খুশি। শ্রমিকেরা চান সরকারের দেওয়া সময়ের মধ্যেই তাঁদের নতুন মজুরিকাঠামো অনুযায়ী বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধ করা হোক।

প্রস্তাবিত মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের আশ্বাসে নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলের শ্রমিকেরা কাজে ফিরেছেন। আজ সকাল ছয়টা থেকে কাজ শুরু করেন শ্রমিকেরা।

পাটকলটিতে কর্মচাঞ্চল্য ফেরায় ও উৎপাদন শুরু হওয়ায় খুশি শ্রমিকেরা। তবে পাটের ঘাটতি থাকায় পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না পাটকলটি।

ইউএমসি জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সফিকুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘পাটমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রমিকনেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আশায় আছি আমরা।’