স্থায়ী আমানত নিয়ে সমস্যায় ব্যাংক

দেশের অনেক ব্যাংক এখনো ৯ বছর মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করছে। আর আশ্বাস দিচ্ছে মেয়াদ শেষে তিন গুণ টাকা ফেরত দেওয়ার, যাতে সুদহার পড়ছে ১২ শতাংশের বেশি। এমন ব্যাংকের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ৬ বছর মেয়াদি আমানত নিচ্ছে সবাই, যাতে সুদহার পড়ছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ।

এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী এপ্রিল মাস থেকে আমানতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া যাবে না। আর ঋণের সুদ হবে ৯ শতাংশ। এতে দীর্ঘমেয়াদি আমানত যার যত বেশি, তার আয় কমবে তত বেশি। কারণ, ব্যাংক আমানতের ৩০ শতাংশই ৬ মাস থেকে ৯ বছর মেয়াদি। আর গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যাংকগুলো সুদ দেওয়ার যে চুক্তি করেছে, তা লঙ্ঘনেরও কোনো সুযোগ নেই। বেশি সুদ দেওয়া অব্যাহত রাখলে লোকসান গুনতে হবে। এতে বড় সমস্যায় পড়বে পুরো ব্যাংক খাত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো যেসব দীর্ঘমেয়াদি আমানত নিয়েছে, তার সুদ কমানোর কোনো সুযোগ নেই। ফলে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হলে অনেক ব্যাংক সমস্যায় পড়ে যাবে। এত ব্যাংক খাত বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। আয় কমে যাবে। এ জন্য কম সুদের আমানত নিয়ে লোকসান সমন্বয় করতে হবে।

হেলাল আহমদ চৌধুরী আরও বলেন, যেসব ব্যাংক ৯ বছর মেয়াদি আমানত নিয়েছে ও নিচ্ছে, তারা ঠিক করেনি। এসব তদারক করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। ব্যাংক আমানতের মধ্যে ২ লাখ ২৬ হাজার ২১৯ কোটি সরকারি খাতের। বাকি ৯ লাখ ১৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকার আমানত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির। এর মধ্যে স্থায়ী আমানত ৫ লাখ ২৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। আর ৬ মাসের কম মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদি আমানতের মধ্যে ৬ মাস থেকে ১ বছর মেয়াদি ৮৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা, ১ থেকে ২ বছর মেয়াদি আমানত ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। ২ থেকে ৩ বছর মেয়াদি ৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ও ৩ থেকে ৯ বছর মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ৬৮ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। আর সুদবিহীন আমানত আছে ৮৩ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।

>

মোট আমানতের ৩০ শতাংশ ৬ মাস থেকে ৯ বছর মেয়াদি আমানত। এসব আমানতের সুদহার কমানো যাবে না। এতে ব্যাংকগুলোর আয় কমবে।

গত সোমবার ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সঙ্গে এক বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, আগামী এপ্রিল থেকে সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে। আর আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো কাউকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিতে পারবে না। তবে ক্রেডিট কার্ডে সুদহার বেশি হবে।

এরপরই ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা অনেকটা চাপে পড়ে গেছেন। উচ্চপর্যায়ের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও এর প্রভাব তুলে ধরছেন ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায়। তাঁরা বলছেন, তিন মাস সময় দেওয়ায় ক্ষতি কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। তবে সুদ ৬ শতাংশ করে দিলে আমানত পাওয়া যাবে না। এতে ব্যাংক ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়বে। লোকবল ও শাখা কমিয়ে কার্যক্রম ছোট করে আনতে হবে অনেক ব্যাংকের।

নতুন সুদহার বাস্তবায়িত হলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্থায়ী যেসব আমানত রয়েছে, তার সুদ কমানোর কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য যাদের স্থায়ী আমানত যত বেশি, তারা বেশি চাপে পড়বে। এটাই বাস্তবতা। আয় কমে যাবে, মুনাফাতেও প্রভাব পড়বে। তবে দেশের উন্নতি করতে সুদহার কমাতেই হবে।

আবদুল হালিম চৌধুরী আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। খেলাপি ঋণ কমে এলে সুদহার এমনিতেই কমে যাবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকে বেসরকারি আমানতের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকদের ৫ লাখ ৮৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, চাকরিজীবীদের ২ লাখ ৩ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। আর গৃহিণীরা জমা করেছেন ১ লাখ ৭ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। প্রবাসীদের জমা আছে ৪৩ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, চিকিৎসক, আইনজীবী, স্থাপত্যবিদ, ঠিকাদার, পরামর্শকদের আমানত ৪২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা, কৃষক ও মৎস্যজীবীদের ২৬ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ও বিদেশিরা জমা রেখেছেন ৬৩৯ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্থায়ী আমানতের সুদ কমানো যাবে না। তবে ৬ শতাংশ সুদে আমানত পেলে ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করা যাবে। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আমানতের সুদ ৬ শতাংশ হবে। তাই এবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে।

৬ শতাংশ সুদে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশেও সুদ কম। তাই আমাদের সুদ কমানো হলেও মানুষ টাকা রাখবে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে ব্যাংকে টাকা রাখলে নানা রকম সেবা মাশুল দিতে হয়। আবার মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। ফলে আমানতে ৬ শতাংশ সুদ কার্যকর হলে আমানতকারীদের তেমন কিছুই থাকবে না। ফলে মানুষ আবারও সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকবে। কারণ, সঞ্চয়পত্রে সুদ এখনো ১০ শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ৬ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট করে দিলে গ্রাহকদের টাকার মান কমে যাবে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। তখন ঋণ দেওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে পুরো খাতে হযবরল পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য এসব উদ্যোগ বন্ধ করে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, সুদহার কমিয়ে চাপে পড়লে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ওপর বাড়তি মাশুল আরোপ করা শুরু করবে। কারণ, বেসরকারি ব্যাংক কখনোই লোকসান দেবে না। এটাই তাদের নীতি।