দরপতনের গ্যাঁড়াকলে শেয়ারবাজার

>গত দুই দিনে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি প্রায় ৩ শতাংশ বা ১২৭ পয়েন্ট কমে ৪৪ মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।

বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। সরকারের চলতি মেয়াদের প্রথম বছরটি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল চরম হতাশার। বছরজুড়েই বাজারে দরপতন ঘটেছে। তাতে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারীরা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা দফায় দফায় বৈঠক করেও বাজারে প্রাণ ফেরাতে পারেননি। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নেওয়া কোনো পদক্ষেপেরই সুফল মেলেনি বাজারে। বাজার যেন দরপতনের গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছে। পতনের এ গ্যাঁড়াকলে আটকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরাও। 

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপস্থিতিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই বৈঠকের পর গত দুই দিনে বাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এ দুই দিনে প্রায় ৩ শতাংশ বা ১২৭ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৩৩২ পয়েন্টে। তাতে ডিএসইএক্স সূচকটি গত ৪৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সর্বশেষ এ সূচকটি ২০১৬ সালের ১৭ মে ডিএসইএক্স সূচকটি ৪ হাজার ৩২৭ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। 

গত বছরের ৭ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন ও শপথের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় বর্তমান সরকারের। সরকারের এই এক বছরে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি কমেছে ১ হাজার ৩৫৫ পয়েন্ট বা সোয়া ২৩ শতাংশের বেশি। আর এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে বাজার মূলধন। গত বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত বাজার মূলধন কমেছে প্রায় সাড়ে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে লেনদেন হাজার কোটি থেকে কমে নেমে এসেছে ৩০০ কোটিতে। 

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর এত দীর্ঘ সময়ের মন্দা অতীতে আর দেখা যায়নি। এ জন্য সুশাসনের ঘাটতি ও বাজার পরিচালনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতাকেই অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলছেন, বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে। এ অবস্থায় আস্থার সংকট দূর করা না গেলে বাজারকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুনর্গঠন জরুরি বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বড় অংশ। 

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে এত দীর্ঘকালীন মন্দা আর দেখা যায়নি। আমাদের এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালের জুলাই-অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাজার ৬৩ শতাংশের বেশি অস্থিরতা ছিল। বাজার পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবস্থান আগের চেয়ে আরও বেশি দুর্বল হয়েছে। সুশাসনের বড় ধরনের ঘাটতি শেয়ারবাজারের এ মন্দাবস্থাকে দীর্ঘায়িত করেছে। 

 ব্রোকারেজ হাউসের একাধিক শীর্ষ নির্বাহী ও বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে বিনিয়োগকারীরা যে যাঁর আগে শেয়ার বিক্রি করছেন, তাঁরই লোকসান কমছে। চরম অনাস্থা থেকে বিনিয়োগকারীরা ভালো-মন্দনির্বিশেষে শেয়ার বিক্রির প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। বাজারের এবারের দরপতনে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক ভূমিকা ছিল ভালো মৌল ভিত্তির কোম্পানির। উল্লেখযোগ্য হলো গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মাসহ আরও বেশ কিছু কোম্পানি। 

সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার পাওনা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে গ্রামীণফোনের দ্বন্দ্বের কারণে কোম্পানিটির শেয়ারের দামে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গ্রামীণফোন বড় মূলধনি কোম্পানি হওয়ায় সেটির দরপতনের ধাক্কা লাগে সূচকেও। 

মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকালের বড় দরপতনের পেছনে যে তিনটি কোম্পানির সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ছিল তার মধ্যে রয়েছে গ্রামীণফোনও। অপর দুটি কোম্পানি হলো ব্র্যাক ব্যাংক ও স্কয়ার ফার্মা। খাতভিত্তিক দরপতনের ক্ষেত্রে গতকাল শীর্ষে ছিল জীবন বিমা খাত। 

ভালো সূচকটিও একেবারে তলানিতে

ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে ভালো মানের ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকটি। গতকাল দিন শেষে এ সূচকটি নেমে এসেছে ১ হাজার ৪৫২ পয়েন্টে। গত ছয় বছরের বেশি সময় পর এটিই এ সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান।