ভোজ্যতেলে দাম বাড়ছে, করও বাড়ছে

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে দেশে। ইতিমধ্যে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অনেকটাই বেড়েছে। নতুন দরের তেল এলে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বাড়তি দামের তেলে সরকারের করের পরিমাণও বাড়ছে। বিশেষ করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট)। চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলের ওপর তিন পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ করা হয়, যা আগে শুধু আমদানি পর্যায়ে আদায় করা হতো। এ ছাড়া অগ্রিম করও দিতে হচ্ছে আমদানি পর্যায়ে।

>

দুই মাসে খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৭ টাকা ও পাম সুপার তেল ১৬ টাকার মতো বেড়েছে 
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪ থেকে ৮ টাকা বাড়িয়েছে বিপণনকারীরা

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের (বিটিসি) এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালের মে মাসে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি মূল্য ছিল ৬৫৪ ডলার। এতে ভ্যাট দাঁড়াত ৮ হাজার ৭০০ টাকা, প্রতি লিটারে ৮ টাকা ৭০ পয়সা। গত ২০ ডিসেম্বর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৭৯৪ ডলারে উঠেছে। এ দরের ওপর নতুন বাজেটের ভ্যাট কাঠামো ও অগ্রিম কর বিবেচনায় নিলে সরকারের রাজস্ব দাঁড়াবে লিটারে ১৪ টাকা ৮৫ পয়সা, যা মে মাসের তুলনায় লিটারে প্রায় ৬ টাকা বেশি।

একইভাবে পাম তেলে মে মাসের হিসাবে ভ্যাট দাঁড়াত লিটারে ৬ টাকা ৪০ পয়সা, যা ডিসেম্বরের হিসাবে ১৪ টাকা ৪০ পয়সায় উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মানে হলো, বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম যত বাড়বে, ততই ভ্যাট বাড়তে থাকবে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানিতে ভ্যাট ও অগ্রিম কর ছাড়া আর কোনো কর নেই। পাম তেলে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে।

দেশের বাজারে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে খোলা ভোজ্যতেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ৭ টাকা ও পাম সুপার তেল ১৬ টাকার মতো বাড়তি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শীর্ষ বাজার হিস্যাধারী কয়েকটি কোম্পানি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪ থেকে ৮ টাকা বাড়িয়েছে। তারা বলছে, বিশ্ববাজারের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে দেশে না বাড়িয়ে উপায় থাকবে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সরকার পদক্ষেপ নিলে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে নভেম্বরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল টনপ্রতি ৭১০ ডলার, এখন তা ৯০০ ডলার ছাড়িয়েছে। একইভাবে ৬০০ ডলারের পাম তেল এখন ৮৫০ ডলার। তিনি বলেন, এভাবে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশে পড়তে পারে। এটি কীভাবে সহনীয় রাখা যায়, তা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

সরবরাহ ‘ঠিক আছে’
দেশে সিটি, টিকে, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, মেঘনা, এস আলমসহ কয়েকটি কোম্পানি অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করার পর তা পরিশোধন করে বিপণন করে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ছিল ২০ লাখ টনের মতো, যা চাহিদার তুলনায় আড়াই লাখ টন বেশি। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আরও ৫ লাখ ১৫ হাজার টন আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশন মনে করে সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না।
দেশে পুরো বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর সিংহভাগ আমদানি হয়। কিছুটা দেশে উৎপাদিত হয়।

তিন সুপারিশ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তারা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনটি সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করতে পারে এবং সরবরাহ ও খুচরা পর্যায়ে কমিশনের হার লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৩ ও ৫ টাকা নির্ধারণ করতে পারে। দ্বিতীয় সুপারিশ হিসেবে অগ্রিম কর তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় সুপারিশে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, আমদানি মূল্যে শতকরা হারের পরিবর্তে টনপ্রতি নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে। কমিশন বলছে, আমদানিকারকেরা যে দামে ঋণপত্র খুলছে, সেই দামে ভোজ্যতেল এলে বোতলজাত করা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম দাঁড়াবে ১২৪ টাকা, যা এখন ১১০ টাকার মধ্যে। দুই পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি, অগ্রিম কর প্রত্যাহার এবং সরবরাহ ও খুচরা পর্যায়ে কমিশন যৌক্তিক করলে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১১০ টাকা রাখা যাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা করছে। বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কর কমানো নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক এখনো হয়নি। বাণিজ্যমন্ত্রী বিদেশ সফরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে আলোচনা হবে।