এখনো ভরসার জায়গা সঞ্চয়পত্র

সঞ্চয়পত্র কিনতে মানুষের আগ্রহ এখনো কম নয়। ছবি: হাসান রাজা
সঞ্চয়পত্র কিনতে মানুষের আগ্রহ এখনো কম নয়। ছবি: হাসান রাজা

শেয়ারবাজারের অবস্থা খারাপ। বলা যায় একেবারে তলানিতে। সুদের হার নয়-ছয় করার তোড়জোড়ে ব্যাংকে স্থায়ী আমানতেও (এফডিআর) আর আগের মতো সুবিধা মিলবে না। সাধারণ মানুষ, অবসরভোগী মানুষ, সঞ্চয়প্রবণ নারী—সবাই তাহলে যাবেন কই এখন? বাচ্চার স্কুলের বেতন কীভাবে দেবেন তাঁরা? ওষুধ খরচ কই পাবেন? মাসিক চলার খরচ জোগাবেন কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের জবাবে নির্দ্বিধায় তাদের জন্য সরকারের একটি দরজা এখনো খোলা। সেটা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন একটু কড়া হয়েছে, কিন্তু নিয়মকানুন মেনে চলা মানুষদের জন্য সঞ্চয়পত্র ছাড়া ভরসার আর কোনো জায়গাই যেন নেই।

কারণটাও সহজ। এখনো সবচেয়ে বেশি সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায় সঞ্চয়পত্র থেকেই। তবে এক লাখ টাকার বেশি হলেই ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে কিনতে হবে—গত ১ জুলাই থেকে এ নিয়ম চালু হওয়ার পর অনেকেই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে সরকারও বেশ নির্ভার। কারণ, গত ১১ বছরে সরকারকে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদই দিতে হয়েছে।

সরকারের দিক থেকে সুখবর হচ্ছে, গ্রাহকদের সুদ দিতে এখন আর সরকারকে বেশি টাকা গুনতে হবে না। আর সরকার ঠিকই এখন তার টাকার প্রয়োজন মিটিয়ে নিচ্ছে সঞ্চয়পত্রের চেয়েও স্বল্প সুদের জায়গা ব্যাংক থেকে ধার করে। এটি অবশ্য অন্য আলোচনা। 

গ্রাহকদের দিক থেকে ভাবতে গেলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমছে। অর্থাৎ সরকার আয়োজন রাখলেও বেশি মানুষ সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ নিতে পারছেন না। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আগেরবারের একই সময়ের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭৩ শতাংশ। 

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শামছুন্নাহার বেগম বলেন, ‘এ খাত এখন একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসছে। এখন বরং সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ যাঁদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়েছে, তাঁরাই তা নিতে পারছেন।’

কী কী সঞ্চয়পত্র
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র—বর্তমানে এ চার ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু রয়েছে। নামের মধ্যেই রয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের নামের মধ্যে মেয়াদ উল্লেখ না থাকলেও এ দুটোও পাঁচ বছর মেয়াদি। আর তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র স্রেফ তিন মাস মেয়াদি। 

পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ মাসিক ভিত্তিতে এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তোলা যায়।

কারা কিনতে পারেন
সবাই সব ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। এ ব্যাপারে সরকার কিছু শর্ত ঠিক করে দিয়েছে। যেমন ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী ও পুরুষেরা শুধু একক নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন।

পেনশনার সঞ্চয়পত্রও কিনতে পারেন না সবাই। অবসরভোগী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র সবার জন্য উন্মুক্ত। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ একক বা যুগ্ম নামে এ দুই ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। নাবালকের পক্ষে সঞ্চয়পত্র কেনার এখন আর সুযোগ নেই।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
সব সঞ্চয়পত্রেরই নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে। গ্রাহকদের এ ফরম পূরণ করতে হয়। সঙ্গে দিতে হয় গ্রাহক ও নমিনির দুই কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি। গ্রাহকের ছবি সত্যায়িত করতে হয় প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর মাধ্যমে। আর নমিনির ছবির সত্যায়ন করবেন গ্রাহক নিজে। গ্রাহক ও নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। নমিনি নাবালক হলে জন্মনিবন্ধনের কপি লাগবে। আগে না লাগলেও সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে এখন লাগে ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন)। এ ছাড়া এখন লাগে গ্রাহকের নিজ ব্যাংক হিসাবের চেকের কপি, যে হিসাবে গ্রাহকের সুদ ও আসল টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে। পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি কাগজ হিসেবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সনদ লাগে।

নমিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ
সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক কোনো কারণে মারা গেলে টাকা পাবেন তাঁর মনোনীত ব্যক্তি বা নমিনি। নমিনি জটিলতা কয়েক বছর আগে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সরকার পরে প্রজ্ঞাপন দিয়ে তা স্পষ্ট করেছিল। সঞ্চয়পত্রে এক বা একাধিক নমিনি করা যায়। যদিও নমিনি মনোনয়ন বাধ্যতামূলক নয়। তবে ভবিষ্যতে নগদায়ন ঝামেলা এড়াতে গ্রাহকেরা সাধারণত নমিনি মনোনয়ন দিয়েই থাকে। এমনকি নাবালককেও নমিনি করা করা যায়। গ্রাহকের মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে আদালত থেকে উত্তরাধিকার সনদ নিয়ে সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন করতে হয়। গ্রাহক ও নমিনি উভয়ই মারা গেলে আইনানুগ উত্তরাধিকারী সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে পারেন।

কত টাকার কেনা যায়
একক নামে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ রয়েছে শুধু পেনশনার সঞ্চয়পত্রেই। এর পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা। তবে এ সঞ্চয়পত্র যুগ্ম নামে কেনার সুযোগ নেই। একক নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় ৪৫ লাখ টাকার। এটাও যুগ্ম নামে কেনা যায় না। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র একক নামে কেনা যায় ৩০ লাখ টাকার। তবে যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত এ সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। আবার পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রও একক নামে কেনা যায় ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এটিও ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত যুগ্ম নামে কেনা যায়। 

কেনা ও ভাঙানো
৫০ হাজার টাকা, ১ লাখ টাকা, ২ লাখ টাকা, ৫ লাখ টাকা এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পেনশনার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। আর পরিবার সঞ্চয়পত্র রয়েছে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের। এগুলো কেনা যায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়, সব তফসিলি ব্যাংক ও সব ডাকঘর থেকে। একই জায়গা থেকে ভাঙানোও যায় এগুলো। ভাঙানোর দিন অবশ্য গ্রাহককে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আবেদন করতে হয়। যেসব জায়গায় পুরোপুরি অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়নি, সেসব জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র আর কেনা যাচ্ছে না।

মুনাফার কিস্তি
পরিবার সঞ্চয়পত্রে এক লাখ টাকায় মাসিক মুনাফা পাওয়া যায় ৮৬৪ টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ত্রৈমাসিক মুনাফা ২ হাজার ৪৮৪ টাকা। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ত্রৈমাসিক মুনাফা ২ হাজার ৬৪৬ টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে একেক বছরের জন্য একেক হারে মুনাফা পাওয়া যায়। 

সঞ্চয়পত্রের আরও কিছু
সঞ্চয়পত্র যেমন উচ্চ সুদ দেয়, তার একটি অন্য অসুবিধাও আছে। যেমন সঞ্চয়পত্র জামানত রেখে কোনো ব্যাংকঋণ নেওয়া যায় না। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে তার বিপরীতে যেমন জরুরি প্রয়োজনে দুই দিনের নোটিশে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সঞ্চয়পত্রে সুদও কম পাওয়া যায়।

সঞ্চয়পত্র হারালে, চুরি হলে, পুড়ে গেলে বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হলে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পর ডুপ্লিকেট কপি পাওয়া যায়। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে এক বছর পার হওয়ার আগেই কেউ ভাঙাতে চাইলে কোনো মুনাফাই দেওয়া হয় না। শুধু মূল টাকা নিতে হয়। আর ইটিআইন ও ব্যাংক হিসাব ছাড়া এখন আর সঞ্চয়পত্র কেনাই যায় না।

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে আসল ও মুনাফার টাকা আর নগদে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙালেও টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে। সত্যায়িত করে দিলে গ্রাহকের মনোনীত ব্যক্তি মুনাফার টাকা তুলতে পারেন। কিন্তু মূল টাকা গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও তোলার কোনো সুযোগ নেই।

সীমার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলে গ্রাহক কোনো মুনাফা পাবেন না। তবে মূল টাকা ফেরত পাবেন। ওয়েবসাইট থেকে ফরম ডাউনলোড করেও তা সঞ্চয়পত্র কেনার কাজে ব্যবহার করা যাবে।