১৭৮৭ সালে ঢাকার রপ্তানি আয় ১ কোটি রুপি

সোয়া দুই শ বছর আগে রাজধানী ঢাকার রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। তৎকালীন ঢাকার কালেক্টর ম্যাথিউ ডে জরিপটি পরিচালনা করেন। ১৭৮৭ সালে করা ওই জরিপের ফল হলো ওই বছর ঢাকার রপ্তানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যের আর্থিক মূল্য হলো প্রায় এক কোটি রুপি। এর মানে ঢাকা থেকে ওই পরিমাণ অর্থের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছিল। ওই জরিপে বলা হয়েছে, এই ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প মূলত বস্ত্রশিল্পনির্ভর। তখন বছরে বস্ত্র খাতেই ছিল ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার বেসাতি। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ঢাকা চেম্বার) প্রকাশিত ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বই থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই বইয়ে বলা হয়, ১৭৮৭ সালের পরে বিলেতি বস্ত্রের ভিড়ে দেশীয় বস্ত্রের বাজার পড়তে থাকে। রপ্তানিও কমে যায়। ১৮৩০ সালে এশিয়াটিক রিসার্চার নামে একটি জার্নালে ঢাকা থেকে বস্ত্র রপ্তানি কমে যাওয়ার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। আর সিংহভাগই ছিল মসলিন।

এশিয়াটিক রিসার্চার জার্নাল অনুযায়ী, ১৭৯০ সালে ঢাকা থেকে ২২ লাখ ৩৬ হাজার সিক্কা রুপির পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সিক্কা রুপি ছিল তৎকালীন মুদ্রা। পরের ১০ বছরে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ১৭৯৯ সালে ঢাকা থেকে বস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৫৬ হাজার সিক্কা রুপি। 

ঢাকা রপ্তানিযোগ্য ব্যবসা-বাণিজ্য পড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, ঐতিহ্যবাহী মসলিনের পতন। ওই সময়ে বস্ত্র রপ্তানির মধ্যে সিংহভাগই ছিল মসলিন। অবশ্য তখন ছিল ঢাকাই মসলিনের শেষকাল। কার্যত ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মসলিন ১৮৩০ সালের পরে বিলেতি বস্ত্রের ভিড়ে বাজার হারায় এবং অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও একটি নদীর ক্ষীণ স্রোতের মতো ঢাকাই মসলিন উনিশ শতকেও কোনোরকমে টিকে থাকতে পেরেছিল। কারণ তখনো বসরা, জেদ্দা, মিসর ও তুরস্কে ঢাকাই মসলিনের চাহিদা ছিল। 

১৮৬২ সালের বিখ্যাত লন্ডন প্রদর্শনীতে ঢাকা থেকে ছয় ধরনের মসলিনের নমুনা পাঠানো হয়, যা বিলেতি তৈরি মসলিনের পাশাপাশি রেখে প্রদর্শিত হয়। ওই প্রদর্শনীতে ঢাকার মসলিনই গুণগত বিচারে প্রথম স্থান অধিকার করে। 

ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের পতনের নানা কারণ আছে। তবে অন্যতম কারণ ছিল ১৭৮০ সালের পর ইংল্যান্ডের বড় বড় কারখানার মিহি সুতার তৈরি নকল মসলিনের প্রাদুর্ভাব এবং এ দেশের বাজার দখল। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর ও পেইসলি ছিল এসব নকল মসলিন ও মিহি সুতার প্রধান উৎপাদন এলাকা। বিলেতে তৈরি মসলিন এত সস্তা ছিল যে প্রতিটি দোকানেই বিলেতি মসলিন পাওয়া যেত। দেখতে প্রায় ঢাকার মসলিনের অনুরূপ, এমনকি তার চেয়েও চাকচিক্যময়, অথচ চার ভাগের এক দামে এসব মসলিন বিক্রি হতো। বিলেতি শিল্প রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মসলিনের ওপর তখন উচ্চ শুল্ক-কর আরোপ করেছিল। ফলে বিলেতে তৈরি অপেক্ষাকৃত সস্তা ও নকল মসলিনের কাছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিনের বাজার হারাতে হয়। ১৭৫৩ সালে যখন ব্রিটিশ বস্ত্র হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তখনো ঢাকা থেকে ২৮ লাখ ৫০ হাজার আর্কট মূল্যের বস্ত্র রপ্তানি হয়েছিল। আর্কট ওই সময়ের একটি মূল্যমান। ১৮১৩ সালে বিলেতি বস্ত্র যখন বাংলায় ব্যাপকভাবে আমদানি হতে শুরু করে তখন ঢাকা রপ্তানি কমে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার ১৮৮ সিক্কা রুপি।