সরকারের ধার: ছয় মাসেই পুরো বছরের ঋণ

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুরো অর্থবছরের জন্য ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার, ছয় মাসেই তা নিয়ে ফেলেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। তবে ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার ঋণ নিয়েছে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আয়ের তুলনায় সরকারের ব্যয় বেশি থাকে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত থেকে অর্থ ধার করতে হয়। কোন খাত থেকে কত টাকা ধার করতে হবে, তার একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্থবছরের শুরুতেই ঠিক করে নেয় সরকার। বাজেটে তার ঘোষণা থাকে। এর ব্যত্যয় হলে সরকারের নগদ অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক—উভয় উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। 

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে ঋণ নেওয়া অব্যাহত থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। এমনিতে বেসরকারি ঋণ অনেক কমে গেছে। তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিও কমে যাবে এবং সরকারের যে লক্ষ্য আছে, তা অর্জন করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ব্যাংক খাত থেকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে। রাজস্ব আদায়ও কম। এদিকে কমে গেছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি। আর্থিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এসব কারণেই অর্থের জন্য সরকারকে ব্যাংকের ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর ধারের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এবার ছয় মাসেই সেই রেকর্ড ভেঙে গেছে। ছয় মাসের ধারসহ ব্যাংক ব্যবস্থার কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। অথচ গত জুনেই এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকার টান পড়ে বেশি।

>

ব্যাংক থেকে সরকারের এত অল্প সময়ে এত বেশি ধার নেওয়ার ঘটনা গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই বেশি

অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, আর্থিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের এত বেশি ধার নেওয়ার প্রবণতায় চিন্তিত। তাঁদের মতে, এবার শুরু থেকেই অর্থের টান শুরু হয়েছে। শেষের দিকে সরকারের টাকার চাহিদা আরও বাড়বে। আর্থিক খাতের যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেভাবে চলছে, তাতে অর্থবছর শেষে সরকারের ধারের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের ঋণের ভাগ কমে যাবে এবং বিনিয়োগ ব্যাহত হবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে চেয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা; যা ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার চাপে রয়েছে পুরো ব্যাংক খাত। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের খারাপ অবস্থার চাপও ব্যাংক খাতে রয়েছে। ঠিক এমন সময় খরচ মেটাতে সরকার এসে ভর করছে ব্যাংক খাতের ওপর।

বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায় ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে। এ কারণে সরকারকে ব্যাংকমুখী হতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আবার বেঁধে দেওয়া হচ্ছে আমানতের সুদহার। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য নিয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। এ জন্য বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মচারীরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অর্থ ধার বাড়লেও এবার সঞ্চয়পত্র কম বিক্রি হওয়ার একটা সুফল পাবে সরকার। কারণ, সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে গ্রাহকদের উচ্চ হারে যে সুদ দিতে হতো, তা এবার কম দিতে হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। বাকি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঘাটতি (অনুদান বাদে)। এই ঘাটতিরই একটি অংশ সরকার পূরণ করছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২৬ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় করেছে। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের কম সংগ্রহ হয়েছে ৭৩ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা।

তবে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসবে বলে সরকার আশা করছে। এ জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত আইনটি চলতি মাসেই পাস হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।