ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রতিরোধের চেষ্টা ছিল

শুধু রাজনৈতিকভাবেই ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করা হয়নি; ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছিল। উপনিবেশবিরোধী স্বদেশি চেতনা দিয়েই বিশ শতকের শুরুতে এ দেশে শিল্পকারখানা তৈরির পটভূমি তৈরি হয়েছিল। দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তারা যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, সেগুলো পরিচিতি পায় ‘স্বদেশি শিল্প’ হিসেবে। এই স্বদেশি উদ্যোগ শুধু কলকাতায় নয়; ঢাকায়ও বিস্তার ঘটে। 

এই স্বদেশি শিল্পোদ্যোক্তারা সম্পূর্ণ দেশজ শিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও ঢাকা তথা পূর্ব বাংলায় শিল্পকারখানা বিস্তারের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। 

১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বাংলা ও আসাম যখন আলাদা প্রদেশের মর্যাদায় ছিল, তখন স্বদেশি শিল্পের উদ্যোগ বেশি ছিল। শিল্পের এই পুনরুজ্জীবনে তাঁত, হোসিয়ারি, কাপড় কল, ওষুধ, সাবান, পাদুকা, চামড়া—এসব পণ্য প্রাধান্য পায়। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রকাশিত ‘ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস’ বইয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ওই বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৪-০৫ সালে গুপ্ত অ্যান্ড কোং নামে ঢাকার পাটুয়াটুলীতে একটি কারখানা গড়ে ওঠে, যার মূলধনের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার টাকা। এই কারখানার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন একজন স্বদেশি নেতা। এই কারখানায় সুতা রং করা হতো। ওই সময়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নামজাদা ছিল দাস ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং, দে সরকার অ্যান্ড কোং, বেঙ্গল হোসিয়ারি সাপ্লাই অ্যান্ড কোং, স্বদেশি শিল্পালয়, গাঙ্গুলী অ্যান্ড কোং। তবে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের। বিনিয়োগের পরিমাণও কম ছিল। 

১৯২২ সালে বড় ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘দি ঢাকেশ্বরী কটন মিল’ নিবন্ধন পায়। ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ছিল দুই হাজারের বেশি। উদ্যোক্তাদের দেশপ্রেম ও স্বদেশি চেতনায় এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। 

শিল্পের আরেক শাখা, ওষুধশিল্পে স্বদেশি চেতনায় আরেক উদ্যোক্তা শ্রেণি এগিয়ে এসেছিল। হাজার বছর ধরে বাংলার গ্রামগঞ্জে লোকায়ত ‘আয়ুর্বেদীয়’ ওষুধ যুগ যুগ ধরে সমাদৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু উপনিবেশ সরকার ব্রিটিশ ওষুধশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে দেশি ওষুধকে অকার্যকর ও হানিকর বলে প্রচার করে। কিন্তু ঢাকার স্বদেশি উদ্যোক্তারা কলকাতার স্বদেশি শিল্প মালিকদের মতো প্রাচীন শাস্ত্রীয় ওষুধ তৈরি ও বিপণন করার প্রয়াস নেন। দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা আয়ুর্বেদ ফার্মেসি লিমিটেড। ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানটির ওষুধের বিস্তার তৎকালীন পূর্ব ভারতের সর্বত্র ছিল। স্বদেশি প্রতিষ্ঠানের জোয়ারে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদিক মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, গৌর নিতাই আয়ুর্বেদ ঔষধালয়, শক্তি ঔষধালয় ও সাধনা ঔষধালয়। শেষের দুটি প্রতিষ্ঠান এখনো আছে। এসব প্রতিষ্ঠান ওষুধ বিপণনে বিজ্ঞাপনও দিত। 

প্রায় ১১৭ বছর আগে ব্রিটিশ প্রসাধনের বিপরীত স্রোতে হেঁটে ঢাকার দেশি উদ্যোক্তারা সাবান কারখানা নির্মাণ করেছিলেন। ১৯০৩ সালে ঢাকার স্বদেশি উদ্যোক্তা কৃষ্ণচন্দ্র সাহা, সত্যমোহন সাহা ও অক্ষয় দাস প্রায় ৩০ হাজার টাকা মূলধন বিনিয়োগ করে গড়ে তোলেন ‘বুলবুল সোপ কোম্পানি’। এ ছাড়া স্বদেশি প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে শত বছর আগে ঢাকায় একটি পাদুকা শিল্প কারখানা ও চামড়া কারখানা স্থাপন করা হয়। শতাধিক চর্মকার ওই কারখানায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য ওই সময়ে সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল ‘ইস্ট বেঙ্গল রিভার স্টিম কোম্পানি’। এটির মালিক ছিলেন ঢাকা ভাগ্যকূলের জমিদার রাজা শ্রীনাথ রায়। পদ্মা, মেঘনা ও গঙ্গার বুকে পূর্ব বাংলার কোনো স্বদেশি উদ্যোক্তার প্রথম স্টিমার কোম্পানি ছিল এটি। 

১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার পর ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বদেশি আন্দোলনে ভাটা পড়ে। ধীরে ধীরে শিল্প খাতের এই চেতনা হারিয়ে যেতে থাকে। তবে এই স্বদেশি চেতনা ঢাকার শিল্প-বাণিজ্য খাতে নতুন পথরেখা রেখে যায়। বিশ শতকের শুরুর দিকের এই স্বদেশি শিল্প প্রয়াস ঢাকার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ও শিল্পায়নে যে অগ্রযাত্রার সূত্রপাত করেছিল, ১৯৪৭ সালের পর তা আধুনিকতার রূপ নিতে শুরু করে।