প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের দুয়ার

গল্পটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। সরকারি হিসাবে বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসে থাকেন, যাঁদের শ্রম-ঘামের অর্থ প্রতিদিন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে জমা হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেউ অর্থ পাঠান দেশে পুরো সংসারের খরচ মেটানোর জন্য, কেউবা পাঠান সন্তানের লেখাপড়ার জন্য। কেউ আবার বাড়ি করেন, গাড়িও কেনেন। এসব করতে করতে তাঁদের পুরো আয়ই একসময় ফুরিয়ে যায়।

তবে সরকার কিছুটা হিসেবি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভালো একটা বিষয় চিন্তা করে রেখেছে। তাঁদের জন্য দেড় যুগ আগে অর্থাৎ ২০০২ সালে চালু করা হয়েছে ‘ইউ এস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড’ নামে একটি বন্ড। এটি এখনো চলমান। তিন বছর মেয়াদি এই বন্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করতে পারেন। মুনাফার পাশাপাশি অন্য অনেক সুবিধারও আয়োজন করে রাখা হয়েছে এই বন্ডে। ইউ এস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মূল্যমান ৫০০; ১,০০০; ৫,০০০; ১০,০০০ এবং ৫০,০০০ মার্কিন ডলার। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বন্ডে বিনিয়োগের নিম্ন সীমা থাকলেও কোনো ঊর্ধ্ব সীমা নেই। সর্বনিম্ন ৫০০ ডলার দিয়ে এই বন্ডে বিনিয়োগ করা যায়। 

কারা কিনতে পারেন 

‘অনাবাসী হিসাব ধারক’ প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই বন্ড কিনতে পারেন। অর্থাৎ এই বন্ড কিনতে হলে প্রবাসী বাংলাদেশি অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক হতে হবে। তবে বাংলাদেশে অবস্থিত বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যাংক শাখায় ‘অনাবাসী বৈদেশিক মুদ্রা (ফরেন কারেন্সি বা এফসি) হিসাব থাকতে হবে তাঁদের। প্রবাসী বাংলাদেশি নিজ নামে বা আবেদনে তাঁর উল্লেখিত ব্যক্তির নামে অথবা বাংলাদেশে তাঁর মনোনীত ব্যক্তির (বেনিফিশিয়ারি) নামে এই বন্ড কিনতে পারেন। বিদেশে লিয়েনে কর্মরত বাংলাদেশি সরকারি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে কর্মরত কর্মচারীরাও এই বন্ড কিনতে পারেন। বর্তমানে বন্ড কেনার জন্য পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সত্যায়ন ছাড়াই প্রবাসী বাংলাদেশিরা কেবল পাসপোর্টের কপি দিয়ে এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকেরা ‘No Visa Required’ সিল–সংবলিত পাসপোর্টের কপি দিয়ে এই বন্ড কিনতে পারেন। 

কোথায় কেনা যাবে 

বাংলাদেশের সব তফসিলি ব্যাংকের অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখা, বিদেশে যেকোনো বাংলাদেশি ব্যাংক ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যাংক এবং বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশি ব্যাংকের আওতাধীন যেকোনো এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে এই বন্ড কেনা যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানে বন্ড কেনার আবেদনপত্র বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। ফরম পূরণ ও স্বাক্ষর করে বন্ড কেনার আবেদন করা যায়। তবে বিদেশে যেই প্রতিষ্ঠান থেকে বন্ড কেনা হবে, সেই প্রতিষ্ঠানে তা নগদায়ন করা যায় না। সে জন্য বিদেশ থেকে বন্ড কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে আবেদনপত্রে বাংলাদেশের একটি কার্যালয়ের নাম উল্লেখ করতে হয়। 

মৃত্যুঝুঁকি সুবিধা 

এই বন্ডে বিনিয়োগ করলে মৃত্যুঝুঁকি সুবিধাও রয়েছে। তবে মৃত্যুকালীন বিনিয়োগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ন্যূনতম বিনিয়োগ হতে হয় ১০ হাজার মার্কিন ডলার। গ্রাহকের মৃত্যুর আগে বন্ডের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেলে আর মৃত্যুঝুঁকি সুবিধা দেওয়া হয় না। বন্ড ধারকের মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি সুবিধা দাবি করতে হয়। এরপর কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। 

বন্ডের মেয়াদপূর্তির আগে বন্ড ধারক মারা গেলে ক্রয়কৃত বন্ডের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুঝুঁকি সুবিধা দেওয়া হয়। তবে মৃত্যুঝুঁকি সুবিধার অঙ্ক ২০ লাখ টাকার বেশি হবে না। ক্রেতার বয়স মৃত্যুকালে ৫৫ বছরের বেশিও হতে পারবে না। মৃত্যুঝুঁকি সুবিধার দাবি নমিনি বা উত্তরাধিকারীরা দেশে বাংলাদেশি মুদ্রায় অথবা সমমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশ থেকেই নিতে পারবেন। 

সিআইপি হওয়ার সুযোগ

এই বন্ডে ১০ লাখ বা তার বেশি অঙ্কের ডলার বিনিয়োগ করলে ক্রেতাকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে ঘোষণা করবে সরকার। তবে নগদায়নের কারণে বিনিয়োগ যদি ১০ লাখ ডলারের নিচে নেমে যায় এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে ওই সীমা তিনি অর্জন করতে না পারেন, তাহলে তিনি সিআইপি সুবিধা পাবেন না। 

 নমিনির অধিকার

বন্ড ধারক মারা গেলে বন্ডের মূল্য, সুদ ও মৃত্যুঝুঁকি সুবিধা নিতে পারেন নমিনি। তবে প্রতিটি সনদের জন্য একজনের বেশি নমিনি দেওয়ার সুযোগ নেই। আবার বন্ড ধারক মারা যাওয়ার আগে নমিনি মারা গেলে এই নমিনির কোনো কার্যকারিতা থাকে না। সে ক্ষেত্রে নমিনি পরিবর্তন করতে হয়। আবার বন্ড ধারক মারা যাওয়ার আগে নমিনি মারা গেলে মৃত বন্ড ধারকের উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীরা বন্ডের মেয়াদপূর্তিতে মূল্য ও মুনাফা পাবেন। তবে উত্তরাধিকারীরা শুধু মেয়াদপূর্তিতে মূল্য ও মুনাফা নিতে পারবেন। বন্ড ধারকের মৃত্যুর পর নমিনি অনাবাসী হলে ইউ এস ডলারে এবং নিবাসী হলে বাংলাদেশি টাকায় আসল ও মুনাফা পাবেন। 

 পুনর্বিনিয়োগযোগ্য

এই বন্ডের আসল অঙ্ক পরের তিন বছরের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগযোগ্য। বন্ড ধারক চাইলে আবেদন করতে পারেন। তখন তাঁর এফসি হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রায় তা জমা হয়ে যাবে। বন্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার সুবিধাও রয়েছে। হারিয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা নষ্ট হলে ডুপ্লিকেট বন্ড ইস্যুর সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ডুপ্লিকেট বন্ডের জন্য আবেদন করা যাবে। আবেদনের তারিখ থেকে পরের ২ মাসের মধ্যে ডুপ্লিকেট বন্ড ইস্যু করা হয়। বন্ডের বিপরীতে আসল ও মুনাফা ইউ এস ডলারে পরিশোধ করা হয়। তবে বন্ড ধারক বা নমিনির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসল ও মুনাফা বাংলাদেশি টাকায়ও পরিশোধ করা যাবে। 

মুনাফা আয়করমুক্ত

এই বন্ডে বিনিয়োগকৃত এবং অর্জিত মুনাফা আয়করমুক্ত। আর মেয়াদ শেষে মুনাফা রয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতেও সরল সুদে এই মুনাফা তোলা যায়। তবে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে বন্ড নগদায়ন করলে মুনাফা কমবে। এমনকি বন্ড কেনার তারিখ থেকে এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কোনো মুনাফাই দেওয়া হবে না। তবে এক বছর পূর্ণ হওয়ার পরে কিন্তু দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে নগদায়ন করলে মুনাফা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পরে কিন্তু তিন বছরের আগে ৬ শতাংশ এবং ৩ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। 

 অসুস্থ হলে বিকল্প উপায়

অসুস্থতাজনিত কারণে বন্ড ধারক স্বাক্ষর করতে অপারগ হলে বিকল্প উপায় আছে। একজন গেজেটেড কর্মকর্তা কর্তৃক গ্রাহকের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ প্রত্যয়ন করতে হবে। প্রত্যয়ন করার পর অর্থ প্রদানকারী অফিসার সরেজমিনে যাচাই করে, বন্ড উপস্থাপনকারীর পরিচয় ও উপস্থাপিত বন্ডের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বন্ড ধারকের হাতের ছাপ গ্রহণ করে মেয়াদপূর্তি–মূল্য অথবা মুনাফা পরিশোধ করবে। 

বন্ডের ক্রেতা শারীরিকভাবে পঙ্গু হলে বা স্বাক্ষর দিতে সম্পূর্ণ অক্ষম হলেও অর্থ পেতে কোনো অসুবিধা নেই। সে ক্ষেত্রে মেডিকেল সনদ দিতে হয়। বন্ড উপস্থাপনকারীর পরিচয় ও উপস্থাপিত বন্ডের সত্যতা যাচাই করে নমিনি বা উত্তরাধিকারীদের পরিশোধ করা হয় আসল ও মুনাফা। 

 বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ

এত সুবিধা থাকার পরও ইউ এস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের বিক্রি খুব বেশি নয় বলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট সঞ্চয় অধিদপ্তরকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এই বন্ডের ব্যাপারে প্রবাসে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে এবং দেশের বাইরে এই বন্ডের বিক্রয়কেন্দ্র (সেলস পয়েন্ট) বাড়াতে হবে। এ ছাড়া লেনদেন কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে হেল্প ডেস্ক চালুর পাশাপাশি প্রচারণামূলক কাজে দূতাবাসগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে।