১৬৬ বছরের ইতিহাসে চা উৎপাদনে রেকর্ড

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বাড়ায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছিল চা–শিল্প। চাহিদা মেটাতে ২০১০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে আমদানিও শুরু হয়। চা আমদানিনির্ভর হয়ে যাবে কি না, এমন শঙ্কাও ছিল। তবে সব শঙ্কা দূর করে এবার চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে। শুধু তা–ই নয়, এই অঞ্চলে ১৬৬ বছরের চা চাষের ইতিহাসে উৎপাদনেও রেকর্ড হয়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চা উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। গত বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ কেজি। এক বছরে চা উৎপাদন বাড়ার হার প্রায় ১৭ শতাংশ।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। চা চাষ শুরুর পর এত দিন সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২০১৬ সালে। সেবার সাড়ে আট কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়। এবার তার চেয়ে ১ কোটি ১০ লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদিত হয়েছে (২০১৯)।

চা বোর্ড ও বাগানমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চা উৎপাদনে রেকর্ড সাফল্যের নেপথ্যে আছে গত এক দশকে সরকার ও বাগানমালিকদের নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপ। উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানে চা চাষের আওতা বাড়ছে। পরিত্যক্ত বাগান চা চাষের আওতায় এসেছে। কয়েক বছর ভালো দাম পাওয়ায় বাগানমালিকেরাও নতুন নতুন বিনিয়োগ করেছেন। বাগানে প্রযুক্তিগত ব্যবহারও বেড়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, চা চাষের আওতা ও উৎপাদন বাড়াতে চা বোর্ডের ধারাবাহিক তদারকি এখন আগের চেয়ে বেশি। গত বছর সঠিক সময়ে বাগানে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ শুরু হয়েছে। উৎপাদন বাড়াতে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান এখন নিয়মিতই মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করছেন। মন্ত্রণালয়েরও নজরদারি বেড়েছে। এসব সম্মিলিত কার্যক্রমের সুফল এই রেকর্ড উৎপাদন।

চা বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ১৪ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত বছরে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৪০ লাখ কেজি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ১০ লাখ কেজি চা বেশি উৎপাদিত হয়েছে। এই উৎপাদন হয়েছে সিলেট, চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ ও পার্বত্য এলাকার ১৬৭টি চা–বাগান ও দেড় হাজার ক্ষুদ্র চা–চাষিদের হাত ধরে।

চা–বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি শাহ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চা–বাগানে কয়েক বছর ধরে কার্যত সংস্কার কার্যক্রম চলছে। পুরোনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। বাগানমালিকেরা নতুন নতুন বিনিয়োগ করে চা চাষের আওতা বাড়িয়েছেন। গত বছর চা চাষের উপযোগী আবহাওয়া ছিল। এবারের মতো যদি উৎপাদন বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে আর বড় আকারে আমদানি করতে হবে না।

দেশীয় বাগানে উৎপাদিত চা বিক্রি হয় চট্টগ্রাম ও সিলেটে দুটি নিলাম বাজারে। উৎপাদন বাড়ায় এবার নিলাম বাজারে চায়ের দাম কমছে। তাতে খুচরা বাজারেও চায়ের দাম কমতে শুরু করেছে। চা বোর্ড গত বছর ২৭ লাখ কেজি চা আমদানির অনুমতি দিয়েছিল ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে সিংহভাগ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় গত বছরের জুন পর্যন্ত। উৎপাদন বাড়ার পূর্বাভাস থাকায় গত বছরের জুনের পর আমদানিও কার্যত কমে গেছে। শুধু প্যাকেটজাত কোম্পানিগুলো চায়ের স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে সামান্য পরিমাণ আমদানি করছে।

উৎপাদন বাড়ায় আমদানি কমার পাশাপাশি দেশীয় বাগানে উদ্বৃত্ত চা এখন রপ্তানি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ছয় লাখ কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি ইস্পাহানি টি লিমিটেড চায়ের একটি চালান যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির জন্য চা বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়েছে। গত বছরে উৎপাদিত চা রপ্তানি হবে এ বছর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

চা ব্যবসায়ীদের সংগঠন টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও ইস্পাহানি টি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক শাহ মঈনুদ্দীন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চা উৎপাদন বাড়ায় নিলাম বাজারে দাম কমছে। তবে এখন চায়ের মান বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, চাহিদার অতিরিক্ত চা বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে হলে মান ঠিক রাখতে হবে।

লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ চীন। ২০১৮ সালে চীনে চা উৎপাদিত হয় ২৬১ কোটি কেজি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে চা উৎপাদিত হয়েছিল ১৩১ কোটি কেজি। সংস্থাটির দুই বছর আগে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম।