বড় অঙ্কের আয়ের জন্য পণ্য বিক্রির মেলা করছে ইপিবি

মো. হেলাল উদ্দিন, সভাপতি
মো. হেলাল উদ্দিন, সভাপতি
>

সারা দেশে দোকানের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। এদের প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। বর্তমানে দোকানদারদের ব্যবসা পরিস্থিতি, ভ্যাট নিয়ে সমস্যা, বাণিজ্য মেলার কারণে বেচাবিক্রিতে প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: সারা দেশের দোকানদারদের ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন চলছে?

হেলাল উদ্দিন: ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। বর্ণনা করার মতো না।

প্রথম আলো: কেন ব্যবসা খারাপ?

হেলাল উদ্দিন: প্রথমত, দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। দ্বিতীয়ত, শীতকাল উপলক্ষে বাণিজ্য মেলার নামে বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বিক্রির মেলা চলছে। ফলে দোকানপাটে গরম পোশাক থেকে শুরু করে অধিকাংশ পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। মেলা সাংঘাতিকভাবে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করছে।

প্রথম আলো: নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়েছে। আগের মতো প্যাকেজ ভ্যাট আর নেই। দোকানদারেরা বর্তমানে ভ্যাট আইন নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়ছেন কি?

হেলাল উদ্দিন: নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিজেরাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। আমরা বলেছিলাম, নতুন আইন কার্যকর হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। সত্যিকার অর্থে তা–ই হয়েছে। ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনার জন্য এখন পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) আমদানি করতে পারেনি এনবিআর। এখন রাজস্ব কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের বিষয়ে বলছেন, যা পারেন দেন। আমরাও দেওয়ার চেষ্টা করছি। নতুন ভ্যাট আইন প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু সেই প্রযুক্তি ও জ্ঞান কোনোটাই আমাদের ব্যবসায়ীদের নেই। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নতুন আইনে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন ভ্যাটের আওতামুক্ত ছিল। তবে কয়েকটি খাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন জারি করে সুবিধাটি রহিত করেছে এনবিআর। বিষয়টি নিয়ে আমরা এনবিআরের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করছি।

প্রথম আলো: প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকায় মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা চলছে। এতে ঢাকার দোকানদারেরা কি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন?

হেলাল উদ্দিন: বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) যৌথ আয়োজনে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার নামে যেটি হচ্ছে সেটিকে আমি পণ্য বিক্রির মেলা বলব। দীর্ঘদিন ধরে ইপিবি এই অনৈতিক কাজটি করছে। ইপিবির কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পণ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা। পৃথিবীর কোথাও পণ্য প্রদর্শনী তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি হয় না। সেখানে কোনো পণ্য বিক্রি হয় না, কেবল ব্যবসায়ীরা পণ্যের ক্রয়াদেশ দিতে পারেন। অথচ বড় অঙ্কের টাকা আয়ের জন্য প্রতিবছর পণ্য বিক্রির মেলার আয়োজন করছে ইপিবি। সেখান থেকে অবৈধ আয়ের সুযোগও ঘটে। সেটি বন্ধ করার জন্যই এফবিসিসিআই থেকে লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হলেও অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই দেশীয়। তাদের পণ্যই বিক্রি করার জন্য দোকানদারেরা বিনিয়োগ করেছেন। সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছেন। তবে মেলায় একটা পণ্য কিনলে দশটা পণ্য ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে একেকটি ব্লেজার। একেকটি ব্লেজার বানানোর মজুরিই তো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। তাহলে এই মেলা কেন এক মাস চলতে হবে? এ ধরনের মেলা বন্ধের বিষয়ে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

প্রথম আলো: গত বছর আপনারা বাণিজ্য মেলার সময় বাড়ানোর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। এবারও মেলার সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আপনারা কি কোনো ব্যবস্থা নেবেন?

হেলাল উদ্দিন: চলতি বছর যদি মেলার সময় বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে আমরা ঢাকার সব দোকানমালিক দোকানপাট বন্ধ করে মেলার দিকে অগ্রসর হব। সংবাদ সম্মেলনের মতো কোনো কর্মসূচিতে যাব না।

প্রথম আলো: হকারদের জন্য ঢাকার মানুষজন ফুটপাত ধরে চলাফেরা করতে পারেন না। একইভাবে দোকানদারেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিষয়টির সমাধানে আপনারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?

হেলাল উদ্দিন: হকারদের সঙ্গে সমাজের রথী–মহারথীরা জড়িত। রাজধানী থেকে হকার উচ্ছেদ করতে হলে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাঁরা ফুটপাতে হকার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা–বাণিজ্য করেন, তাঁরাও যে ভালো আছেন, বিষয়টি তা নয়, অনেককে ম্যানেজ করে ফুটপাতে তাঁদের ব্যবসা করতে হয়। হকারদের পুনর্বাসনের কথা বহুবার বলা হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আশপাশের দেশে কীভাবে হকারদের সড়ক থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে, সেই পদ্ধতি ঢাকায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের মত হচ্ছে, ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হলে প্রথমে প্রকৃত হকারদের চিহ্নিত করতে হবে। তারপর তাঁদের নিবন্ধন দিতে হবে। হকারদের ছয় মাস সময় দিয়ে বলতে হবে বিকল্প ব্যবস্থা করতে। তাঁরা কোথায় যাবেন, কী করবেন, সেটি তাঁদের ব্যাপার। নাগরিকদের চলাচলের জন্য নগরীর ফুটপাত। সেখানে ব্যবসা করা যাবে না। তবে হঠাৎ করে হকারদের তুলে দিলে হবে না। পরিকল্পনা করে শক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে।

প্রথম আলো: হকারদের পাশাপাশি দোকানমালিকেরা অনেক সময় ফুটপাত দখল করে পণ্যসামগ্রী রাখেন। এটি বন্ধ করতে আপনারা কি কোনো ব্যবস্থা নেবেন?

হেলাল উদ্দিন: আপনার অভিযোগের সঙ্গে আমি একমত। তবে হকারদের কারণেই দোকানদারদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক সময় চলে আসে। হকারদের কারণে অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন তাঁর দোকানের পণ্যটি ক্রেতার চোখে পড়ছে না। তখন তিনি তাঁর দোকানের বাইরের জায়গা দখল করে পণ্য রাখেন। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের এই কাজটি না করতে বিভিন্ন সময় বলেছি।