এক দরজায় সেবা: মুখ দেখা বন্ধ, দুর্ভোগও 'নেই'

আবেদন নিয়ে সশরীরে গেলে ঘুষ চাওয়ার সুযোগ থাকে। ফাইল আটকে রেখে গড়িমসিও চলে। কিন্তু আবেদন যদি অনলাইনে আসে, নির্দিষ্ট সময়ে তা নিষ্পত্তি করার বাধ্যবাধকতা থাকে, তাতে টেবিলের তলা দিয়ে লেনদেনের সুযোগ কম।

এটাই নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সেখানে ১৪টি সেবা এখন এক দরজায় বা ওয়ান–স্টপ সার্ভিস সেন্টারের (ওএসএস) মাধ্যমে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।

যেমন ঢাকার অদূরে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে কারখানা করা অস্ট্রেলিয়ার টিআইসি গ্রুপ বলছে, কারখানার জন্য যেসব আমদানির অনুমতিপত্র নিতে হয়, তার জন্য তাদের কর্মকর্তাদের বেজার কার্যালয়ে যেতে হয় না। টিআইসির এ–দেশীয় প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগে বিভিন্ন ধরনের অনুমোদন নিতে যে ভোগান্তি হতো, তা আর নেই। অনলাইনে সেবা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি ফির (মাশুল) বাইরে বাড়তি কোনো খরচও নেই।

বিনিয়োগকারীদের দুর্নীতিমুক্ত ও ভোগান্তিহীন সেবা দিতে বিলুপ্ত বিনিয়োগ বোর্ডে ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। কিন্তু আদতে দেখা গেল, বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ান–স্টপ সার্ভিসে কোনো আবেদন করা হলে অন্য সংস্থাগুলো তা নিষ্পত্তি না করে ফেলে রাখত। ফলে বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ান–স্টপ সার্ভিসকে ব্যবসায়ীরা ‘ফুল স্টপ সার্ভিস’ নাম দিয়েছিলেন।

২০১৫ সালে বেজা ওয়ান–স্টপ সার্ভিস আইন করার প্রস্তাব দেয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাস হয় ওয়ান–স্টপ সার্ভিস আইন। যেখানে বলা হয়, কোনো কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ে সেবা দিতে ব্যর্থ হলে সেটা তাঁর চাকরির অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। আইনের পাশাপাশি বিধিমালা করে কোন সেবা কত দিনে দিতে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

>

এক দরজায় সেবা: অনলাইনে বিভিন্ন সেবা নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সরকারি মাশুলের বাইরে বাড়তি খরচ লাগছে না বলে দাবি।

শুধু বেজা নয়, ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চালুর কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কার্যালয়েও। বিডায় গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ওয়ান–স্টপ সার্ভিস পোর্টাল চালু হয়। বর্তমানে তারা ১৮টি সেবা দিচ্ছে।

ঢাকার বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়কে আবদুল মোনেম বিজনেস ডিস্ট্রিক্টে বেজার কার্যালয়েই ওয়ান–স্টপ সার্ভিস সেন্টার। পুরো ব্যবস্থাটি বেজা তৈরি করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায়। বেজার ওয়ান–স্টপ সার্ভিস সেন্টারে এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারাও দায়িত্ব পালন করেন। কেউ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে চাইলে, প্রকল্প অনুমোদন (৭ দিন), আমদানি ও রপ্তানির অনুমতিপত্র (১ দিন), ভিসা সুপারিশ (২ দিন), কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট (৯ দিন), ভিসা সহায়তা, প্রকল্প নিবন্ধন (৭ দিন), স্থানীয় বিক্রির অনুমতি (২ দিন), স্থানীয় ক্রয়ের অনুমতি (১ দিন), নমুনা আমদানি ও রপ্তানির অনুমতি (১ দিন), ট্রেড লাইসেন্স (৩ দিন), জমি ব্যবহারের পরিকল্পনা (৭ দিন) এবং বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর অনুমোদন এখন অনলাইনেই নিতে পারবেন।

এ মাসের শেষ আর আগামী মাসের মধ্যে মিলবে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন (১ দিনে), নামের ছাড়পত্র ও নাম নিবন্ধন (১ দিন করে), দখলস্বত্ব বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট, পরিবেশ ছাড়পত্র–সংক্রান্ত ৮টি সেবা (১৫ থেকে ৩০ দিন) এবং কারখানার কাঠামো বা লে-আউট পরিকল্পনার অনুমোদন (১০ দিন)। সব মিলে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ ২৭টি সেবা অনলাইনে পাবেন বিনিয়োগকারীরা।

বেজা জানিয়েছে, গত অক্টোবরে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও তারা অনলাইনে আগে থেকেই সেবা দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ২৯৬টি আমদানির অনুমতিপত্র, ৯৪২টি রপ্তানির অনুমতিপত্র, ৩১৭টি ভিসা সুপারিশ, ১১৮টি কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট, ৫১টি প্রকল্প অনুমোদন ও ৭টি প্রকল্প নিবন্ধন সেবা অনলাইনে দেওয়া হয়েছে।

বেজার ২৭টি শ্রেণিতে ১২৫টি সেবা অনলাইনে দেওয়ার কথা। এর মধ্যে ৩৭টি বেজা নিজে দেবে, বাকিগুলো দেবে ২০টির মতো সংস্থা। সে ক্ষেত্রে ওই সব সংস্থার সক্ষমতা তৈরি হওয়া, ওয়ান–স্টপ সার্ভিস সেন্টারে যুক্ত হওয়া ও মানসিকতার পরিবর্তনের বিষয় রয়েছে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, সব বিনিয়োগকারীর সব ধরনের সেবার দরকার হয় না। সাধারণত যেসব সেবা বেশির ভাগের লাগে এবং বারবার নিতে হয়, তা তাঁরা ওয়ান–স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমেই পাচ্ছেন।

বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম, ১৮৯টি দেশের মধ্যে। গেল বছর বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়েছে। একই সময়ে পাকিস্তান ২৮ ধাপ এগিয়ে ১০৮তম হয়েছে। প্রতিযোগীরা মোটামুটি সবাই বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘ওএসএস খুবই ভালো উদ্যোগ। এটা দুর্নীতি ও ব্যবসার ব্যয় কমাবে। কিন্তু দুই বছর ধরে আমরা এক দরজায় সেবার কথা শুনছি। এটার আওতায় দ্রুত সব সেবা নিয়ে আসতে হবে। যেসব সংস্থা এখনো এর আওতায় আসেনি, তাদের নিয়ে আসতে হবে।’