রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৩১,৫০৭ কোটি টাকা

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

সরকারের রাজস্ব আয়ে ভাটার টান বেশ। যে কারণে সরকারের খরচের টাকাই যেন উঠছে না। ফলে খরচ ও আয় বৃদ্ধির চাপে পড়েছে বাজেট। প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না বলে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি সাড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ছয় মাস ধরেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বেড়ে চলেছে।

চলতি অর্থবছরে সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার জোগান দিতে হবে, যা বাজেটের ৬২ শতাংশের বেশি। কিন্তু অর্থবছরের শুরু থেকেই এনবিআর বড় ধরনের হোঁচট খেয়ে আসছে।

এই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এই সময়ে শুল্ক-কর মিলিয়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক-কর, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন খাত থেকে এনবিআর রাজস্ব আদায় করে থাকে।

এনবিআরকে লক্ষ্য অর্জনে গত অর্থবছরের চেয়ে ৪৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। কিন্তু ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এই লক্ষ্য অর্জনে রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়াতে হবে দ্বিগুণের বেশি। আর অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ার মূল কারণ অর্থনীতির শ্লথগতি। সরকারের তরফ থেকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আমদানি তুলনামূলক কম হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আদায় কমছে। আবার করপোরেট খাতের অবস্থাও ভালো নয়, যা রাজস্ব আদায়ে প্রভাব ফেলছে।

>

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় খরচ ও আয় বৃদ্ধির চাপে পড়েছে বাজেট।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, তা নেওয়া হয়নি। যেমন অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির কার্যক্রমে অগ্রগতি নেই। আবার নতুন ভ্যাট আইনও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ছাড়া বিচার-বিশ্লেষণ না করে ঢালাওভাবে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে উদীয়মান অনেক খাত থেকে কোনো রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। সরকার বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পেও কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।

আদায় পরিস্থিতি

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সর্বোচ্চ ঘাটতি হয়েছে আমদানি শুল্কে। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে ১৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। ছয় মাসে শুল্ক আদায়ে লক্ষ্য ছিল ৪৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে আমদানিতে আদায় হয়েছে ৩১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। বিশেষ করে আমদানি শুল্কে প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্প ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমেছে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি হয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট খাতে। এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৫১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি ১০ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। অথচ চলতি বছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়েছে। এতে ভ্যাট আদায় বৃদ্ধির কথা ছিল, কিন্তু আশানুরূপ হয়নি। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ভ্যাট দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনো ব্যবসায়ীরা রপ্ত করতে পারেননি। এ জন্য নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে এনবিআরকে।

তবে ভ্যাট ও শুল্কের চেয়ে আয়কর খাত তুলনামূলক ভালো করেছে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি, ঘাটতিও সর্বনিম্ন। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আয়কর তথা প্রত্যক্ষ করে ঘাটতি হয়েছে ৭ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। এই সময়ে ৪০ হাজার ৭৫ কোটি টাকার লক্ষ্য ছিল, আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশের বেশি।

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি ৯০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। তবে এনবিআর ভালো পারফরম্যান্স করলেও এই ঘাটতি ৮০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে।

রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। তাই সরকার বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক খাত থেকে প্রথম ছয় মাসেই প্রায় পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার সমান ঋণ নিয়ে ফেলেছে। বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা তো পরিশোধ করতেই হবে।