বড় চ্যালেঞ্জ এখন রাজস্ব ও ব্যাংক খাত

চলতি অর্থবছরের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বাজেটের টাকার জোগান দেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। টাকার জোগান দিতে ব্যাংক খাত থেকে পুরো বছরের ঋণ ছয় মাসেই নিয়ে ফেলেছে সরকার। আবার ভালো উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংক থেকে টাকা যাচ্ছে না। বেসরকারি খাতে আগের চেয়ে কম ঋণ গেছে, যা নতুন কর্মসংস্থানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব আছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে এখন বড় দুই চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আদায় ও ব্যাংক খাতে সংকট। 

এর পাশাপাশি অর্থনীতিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। যেমন রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবাহ, মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি। বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে দেশে। মধ্যবিত্তের ভরসার জায়গা সঞ্চয়পত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করায় এর বিক্রি কমে গেছে। গত ছয় মাসে চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস, শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের সংসার চালাতে দুর্ভোগ বেড়েছে।

রাজস্বে ঘাটতি

বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। মোট ঘাটতি হয়েছে ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এনবিআরকে লক্ষ্য অর্জনে গতবারের চেয়ে ৪৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। কিন্তু ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

নতুন ভ্যাট আইনে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি। প্রথম তিন মাসে ভ্যাট আদায় আগেরবারের চেয়ে কমে গিয়েছিল। মূলত নতুন আইনটি বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে নানা জটিলতায় রাজস্ব আদায় কমেছে। 

>লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না
টাকার জোগান দিতে ব্যাংক খাত থেকে পুরো বছরের ঋণ ছয় মাসেই নিয়ে ফেলেছে সরকার

সমস্যায় ব্যাংক খাত

ভালো উদ্যোক্তারা আগের মতো ঋণের জন্য ব্যাংকে ঘুরছেন না। যাঁরা ঋণ চাইছেন, তাঁদের বেশির ভাগ নতুন ও পুরোনো ‘খারাপ’ গ্রাহক। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। আবার মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার চিত্র দিয়েও দেশের বিনিয়োগ চিত্র বোঝা যাচ্ছে। 

সুদের হার নিয়ে কয়েক মাস ধরেই ব্যাংক খাতে একধরনের অস্থিরতা চলছে। আগামী এপ্রিল থেকে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ ও ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সুদহার নিয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীরা আজ মঙ্গলবার সভা ডেকেছেন। 

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম শহীদুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করার মতো ভালো প্রতিষ্ঠান মিলছে না। এ কারণে পুরোনো ভালো গ্রাহকদেরই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার সুদহার কমানো হলে আমানত কীভাবে মিলবে, এটাও বড় প্রশ্ন। 

পূবালী ব্যাংকের এমডি আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, কত সুদে ঋণ দেওয়া হবে তা নিয়ে পুরো বছরই দোটানায় ছিল ব্যাংকগুলো। এ জন্যই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

এদিকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় খরচ মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম ছয় মাসেই সরকার ঋণ নিয়েছে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা। 

আমদানি-রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি নেই

এদিকে আমদানিও বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানির খরচ কমেছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি নিষ্পত্তি কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামালে কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ। এর মানে হলো, শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না, তাই এসব পণ্যের চাহিদা কমেছে। 

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাত। আর এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০০১-০২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। 

এডিপির গতি শ্লথ

চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সরকারি বিনিয়োগ অর্থাৎ এডিপির মাধ্যমে টাকা খরচই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিপুল টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু এবার প্রথম ছয় মাসে আগের চার বছরের তুলনায় কম এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৬.৩৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে। খরচ হয়েছে ৫৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। অবশ্য প্রতিবছর এডিপির আকারও শেষ দিকে ছোট করা হয়। 

মূল্যস্ফীতি চাপে

কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ কম। এবার তা বেড়েছে। চালের দাম স্থিতিশীল থাকছে না, প্রায়ই দাম বাড়ছে। গত ছয় মাসে পেঁয়াজের দাম তো ৫-৬ গুণ বেড়েছে। রসুন, সবজির দামও বেড়েছে। তবে এসব নিত্যপণ্যের দাম এখনো উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল আছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে মূল্যস্ফীতিতে। 

সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কম

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও অনেক কমে গেছে। মূলত সঞ্চয়পত্র কেনায় কড়াকড়ি আরোপ করায় এমন অবস্থা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্তের ওপর। ফলে জুলাই-নভেম্বর সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। 

সুখবর প্রবাসী আয়ে

অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের অবস্থা খারাপ হলেও শুধু ভালো প্রবাসী আয়ে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় সাড়ে ২৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময় তা ছিল ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার ইতিমধ্যে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিয়েছে। 

বিদেশি সহায়তা

বিদেশি সহায়তার ক্ষেত্রে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। গত দুই বছরে বড় বড় প্রকল্পে রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে ১৬ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। ফলে এ বছর থেকে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এবার সব মিলিয়ে ২০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করার লক্ষ্য রয়েছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে এ বছর বিদেশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা শ্লথগতি আছে। অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ২৬০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণচুক্তি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০২ কোটি ডলার কম। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর মাসে ১৬২ কোটি ডলার অর্থ ছাড় হয়েছে, যা এ বছরের লক্ষ্যের মাত্র ২৩ শতাংশ। এ বছর ৭০০ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা ছাড় করার কথা রয়েছে।