মোটরসাইকেলের উড়তে থাকা বাজার যেন মাটিতে নামল

মোটরসাইকেলের উড়তে থাকা বাজার যেন মাটিতে নামল। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে মোটরসাইকেল বিক্রি ১৩ শতাংশ বাড়লেও তা আগের বছরের প্রায় অর্ধেক। ফলে তিন বছর পর বিক্রিতে গতি বেশ কম দেখেছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে মোটরসাইকেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো। তাদের দৃষ্টিতে মূল তিন কারণ হলো—প্রথমত, সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করায় মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ও চালকের লাইসেন্সের ওপর কড়াকড়ি এসেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে মোটরসাইকেল বিক্রিতে; দ্বিতীয়ত, প্রধান ফসলগুলোতে ভালো দাম পাননি কৃষকেরা। এতে গ্রামাঞ্চলে মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে এবং তৃতীয়ত, ব্যাংকঋণের অভাব। বাজারজাতকারীরা বলছে, পরিবেশকেরা প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না বলে কোম্পানির কাছ থেকে মোটরসাইকেল তত বেশি কিনতে পারছে না। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) সভাপতি ও বাজাজ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাতকারী উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছরে সবাই মোটরসাইকেলের দাম অনেক কমিয়েছে। তারপরও বিক্রি ততটা বাড়ল না। তবে চলতি জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বিক্রি আবার বাড়তে শুরু করেছে।’

কোম্পানিগুলো জানায়, দেশে মোটরসাইকেল বিক্রিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন শুরু হয়েছিল ২০১৬ সাল থেকে। উৎপাদনের শর্ত যুক্ত করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। ফলে কোম্পানিগুলো বাজারে মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ পায়। পরের তিন বছর তরতর করে বাজার বাড়তে থাকে।

বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে যেখানে মোট মোটরসাইকেল বিক্রির পরিমাণ ছিল দুই লাখের নিচে, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে সাড়ে পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে বেশি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতা) মোটরসাইকেল। সংখ্যার দিক দিয়ে মোট বিক্রির ৪১ শতাংশের মতো ছিল কম সিসির মোটরসাইকেলের দখলে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ১৫০ সিসি বা তার বেশি ক্ষমতার মোটরসাইকেল। সংখ্যার দিক দিয়ে মোট বাজারের ৩২ শতাংশ বিক্রি হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার মোটরসাইকেল। মাঝারি ১২৫ সিসি ক্ষমতার মোটরসাইকেলের বাজার ছিল মোট বিক্রির ২৭ শতাংশ।

অবশ্য আলোচ্য বছরে বিক্রি বেশি বেড়েছে ১২৫ সিসি এবং ১৫০ সিসি বা তার বেশি ক্ষমতার মোটরসাইকেলের। ১২৫ সিসির মোটরসাইকেল বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ১৫০ বা তার চেয়ে বেশি সিসির মোটরসাইকেলে বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, এই হিসাব কোম্পানিগুলোর নিজস্ব। এটা সে অর্থে বিজ্ঞানসম্মত বাজার জরিপ নয়। বিএমএএমএর সভাপতি মনে করেন, মোট বিক্রির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ লাখ হবে না।

বাজার হিস্যার দিক দিয়ে ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ তার আধিপত্য ধরে রেখেছে। এরপরেই রয়েছে ভারতেরই টিভিএস ও হিরো, জাপানের হোন্ডা ও সুজুকি, দেশীয় ব্র্যান্ড রানার ও জাপানের ইয়ামাহা। এ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের মোটরসাইকেলের বেশির ভাগ মডেল দেশেই তৈরি করছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপনে উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে মোটরসাইকেলের মূল কাঠামোসহ (চেসিস) পাঁচটি প্রধান যন্ত্রাংশের কমপক্ষে একটি দেশে উৎপাদনের শর্ত দেওয়া হয়।

>দেশে মোটরসাইকেলের বাজার দ্রুত বর্ধনশীল খাতের একটি। ২০১৯ সালে এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে, তবে এখনো তা দুই অঙ্কেই রয়েছে।

দেশে পুরো তৈরি মোটরসাইকেল (সিবিইউ) আমদানি করতে ১৫৩ শতাংশের মতো কর দিতে হয়। ফলে দাম অনেক বেশি পড়ে। কোম্পানিগুলো তাদের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ মডেলের মোটরসাইকেলগুলোই শুধু সিবিইউ অবস্থায় আমদানি করে।

বাংলাদেশে ইয়ামাহার একমাত্র পরিবেশক এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস মনে করেন, বাজার যখন ছোট ছিল, তখন অল্প বিক্রিতেই উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখাত। এখন বাজার বড় হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি আগের মতো বেশি না হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধি এতটা কমার জন্য তিনি গ্রামে বিক্রি কমে যাওয়া এবং সড়ক আইনে কড়াকড়ি আরোপের প্রভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, শহরে বিক্রি কিছু ভালোই দেখা যাচ্ছে। 

ইয়ামাহার দাবি, তারা ২০১৯ সালে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩ শতাংশের মতো বেশি। সুব্রত রঞ্জন বলেন, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ এশীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার এখনো কম। ভারতে প্রতি ৩০ জনের ১টি মোটরসাইকেল রয়েছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে প্রতি ৯০ জনের ১টি মোটরসাইকেল। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল সবচেয়ে সাশ্রয়ী বাহন। প্রতি কিলোমিটারে খরচ মাত্র দেড় টাকা।

মতিউর রহমান মনে করেন, বাজারে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে মোটরসাইকেল কিনতে ব্যাংকঋণ দিতে হবে। 

সুব্রত রঞ্জন বলেন, চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দিতে বেসরকারি খাতকে সুযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে বড় কোম্পানিগুলো সরকারের পক্ষে নিজেরাই লাইসেন্স দেয়।