সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে শক্ত উদ্যোগ দরকার

এম শাহাদাৎ হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
এম শাহাদাৎ হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
>

বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন এম শাহাদাৎ হোসেন। হোম টেক্সটাইল খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য, রপ্তানি, নতুন বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে গত বুধবার কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।  

প্রথম আলো: হোম টেক্সটাইল খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন যাচ্ছে?

এম শাহাদাৎ হোসেন: বিদায়ী বছরটি সবার জন্যই বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কেউই সেই অর্থে মুনাফা করতে পারেননি। সবাই কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। তবে আশা করছি, চলতি বছরটি ভালো হবে। কারণ, বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আবারও বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। যদিও পণ্যের দাম নিয়ে আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি, তারপরও ক্রেতাদের বাংলাদেশমুখী হওয়া ভালো লক্ষণ।   

প্রথম আলো: চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে টেরিটাওয়েলের রপ্তানি কমেছে ৩১ শতাংশ। আর হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৯ শতাংশ। রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার কারণ কী?

এম শাহাদাৎ হোসেন: পাকিস্তানের কারণে আমরা মার খেয়েছি। ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির অবমূল্যায়নের কারণে তারা আমাদের চেয়ে বিভিন্ন পণ্যে ২৫ থেকে ২৯ শতাংশ কম দাম অফার করেছে। ফলে ক্রেতারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছেন। মজুরি বৃদ্ধি ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারিনি। অথচ অল্প কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের চেয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়ে ছিলাম। রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে এটাই মূল কারণ। সে জন্যই সরকারের কাছে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রপ্তানির মাধ্যমে দেশে আসা ডলারের বিশেষ বিনিময় হার দাবি করেছি। আমরা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন চাই না। কারণ, তাতে আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে আমরা সমস্যার মুখে পড়ব। তা ছাড়া আমরা বারবার বলতে পারি না, রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা দেন। বর্তমানে যে প্রণোদনা আমরা পাচ্ছি, সেটি ঠিক আছে। 

প্রথম আলো: পণ্য রপ্তানিতে আপনারা কী রকম প্রণোদনা পান?

এম শাহাদাৎ হোসেন: হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। তা ছাড়া ৫০ লাখ ডলার পর্যন্ত রপ্তানি করা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ৪ শতাংশ এবং নতুন বাজারে রপ্তানির জন্য আছে ৪ শতাংশ প্রণোদনা।

প্রথম আলো: শুরুতে আপনি বললেন, ক্রেতারা বাংলাদেশে ফিরছেন। পাকিস্তানে কম দাম পাওয়ার পরও ক্রেতারা কেন আসছেন?

এম শাহাদাৎ হোসেন: কম দাম পেলে এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে এক মুহূর্ত চিন্তা করেন না বিদেশি ক্রেতারা। কম দাম পেয়ে অনেক ক্রেতাই পাকিস্তানে গেছেন। তবে পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকট, উইভিং ও ডায়িং সমস্যার কারণে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারেননি। তখন ক্রেতারা আবার ফিরতে শুরু করেন। তবে পাকিস্তান এখনো আমাদের বড় প্রতিযোগী দেশ। অন্যদিকে মোদি সরকার আসার পর অনেক ধরনের প্রণোদনা দেওয়ায় ভারত দ্রুত প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে।

প্রথম আলো: বর্তমানে কতটি দেশে আপনারা রপ্তানি করছেন?

এম শাহাদাৎ হোসেন: বর্তমানে বিশ্বের ৪৭টি দেশে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমেরিকা, নর্থ আমেরিকা আমাদের বড় বাজার। হোম টেক্সটাইল খাতে ১৪৭টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে রপ্তানি করছে ৬০টি প্রতিষ্ঠান।

প্রথম আলো: হোম টেক্সটাইলের বিশ্ববাজার তো অনেক বড়। সম্ভাবনাময় এই খাতে নতুন বিনিয়োগ কেন আসছে না?

এম শাহাদাৎ হোসেন: হোম টেক্সটাইলে বিশ্ববাজারের আকার ১৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই ৮ হাজার কোটি ডলারের বাজার আছে। তবে সম্ভাবনা থাকলেও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। কারখানা করতে ২৭ জায়গায় ঘোরাঘুরি করে অনুমোদন নিতে হয়। বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়া বর্তমানে অনেক সহজ হয়েছে। নিজের কারখানার জন্য আবেদন করার ১৩ দিনের মাথায় ৪০ কিলোভোল্টের সংযোগ পেয়েছি আমি। কোনো রকম ঘুষ দিতে হয়নি। তবে হোম টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনের জন্য গ্যাস খুবই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। আর গ্যাসের সংযোগের বিষয়টি সরকারের কর্মকর্তারা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। সংযোগ দেওয়ার জন্য একজন উপদেষ্টাকে দিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। তবে তাদের কাছে আমরাই যাওয়ার সুযোগ পাই না। বর্তমানে গ্যাসের সংযোগ পেতে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়, যা নতুন উদ্যোক্তাদের পক্ষে সম্ভব না। হোম টেক্সটাইলে নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় পেছনে এটিই বড় কারণ।

প্রথম আলো: ব্যাংকঋণের সুদের হার নিয়ে ছোট–বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরাই ভোগান্তিতে আছেন। আপনাদের অভিজ্ঞতা কী?

এম শাহাদাৎ হোসেন: শ্রমিকের মজুরি ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ১২-১৩ শতাংশ সুদে ব্যবসা করে মুনাফা তো দূরে থাক, টিকে থাকাই সম্ভব না। ব্যাংক খাতের অরাজকতার জন্য ছোট–বড় সব উদ্যোক্তাই বর্তমানে ভুগছেন। এত উচ্চ সুদে কোনো খাতেই নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। তাতে বড়রাই বড় হবে। সমাজের মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়বে।

প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করছেন, ব্যবসার খরচ বাড়ছে। তো ব্যবসার খরচ সহনীয় পর্যায়ে আনতে কী ধরনের উদ্যোগ দরকার?

এম শাহাদাৎ হোসেন: শ্রমিকের মজুরি ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যেটুকু বেড়েছে, সেটি কমানোর সুযোগ নেই। তবে অন্যান্য জায়গায় সুযোগ আছে। প্রথমত, বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি–রপ্তানিতে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। দ্রুতগতিতে আমদানি ও রপ্তানির পণ্য খালাস করতে হবে। সড়ক ও মহাসড়কে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে শক্ত ব্যবস্থা লাগবে। কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে দেরি হয়ে যাবে। প্রতিযোগী দেশগুলো কিন্তু বসে নেই। তারা তাদের মতো করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, ক্রেতারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তাঁদের আবার ফেরত আনা সহজ হবে না।