চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষে দেশের বড় চার শিল্পগোষ্ঠী

>ভারত রপ্তানি বন্ধের পর দেশে পেঁয়াজের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। তাতে প্রতি কেজির দাম ওঠে ২৫০ টাকায়।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে বড় চারটি শিল্পগোষ্ঠী। ভারত রপ্তানি বন্ধের পর এই বন্দর দিয়ে যত পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, তার ৩৭ শতাংশই এনেছে এই চার শিল্পগোষ্ঠী। এই চার শিল্পগোষ্ঠী হলো মেঘনা, বিএসএম, এস আলম ও সিটি গ্রুপ। চট্টগ্রাম বন্দর, উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র এবং কাস্টমস সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

ভারত রপ্তানি বন্ধের পর ১ অক্টোবর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬২ হাজার ৪০০ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ৮টি দেশ থেকে এই পেঁয়াজ আমদানি করেছে ১৫৮টি প্রতিষ্ঠান, যাদের অনেকেই পেঁয়াজ আমদানিতে নতুন। এর মধ্যে ৪টি শিল্প গ্রুপ ২৩ হাজার ২৮৮ টন বা ৩৭ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করেছে। যেসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, সেখান থেকে আগে কখনোই এত পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়নি।

অবশ্য ভারতের বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে গিয়ে শুরুতে হোঁচট খেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। রপ্তানিকারকেরা চেনাজানা না থাকায় ঋণপত্র খুলে বন্দরে পেঁয়াজের চালান আনতে বাড়তি সময় লেগে যায়। এখন সেই ধাক্কা কেটে গেছে। পেঁয়াজ নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়, তা-ও কিছুটা কমেছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজের সংকটে বিকল্প বাজার যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি নতুন নতুন আমদানিকারক যুক্ত হয়েছেন। এতে আগামী দিনে ভারতসহ অন্য বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানি আরও সহজতর করবে। তবে একই সঙ্গে পেঁয়াজের সরবরাহ যাতে সারা বছর নিশ্চিত হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ করা এবং উৎপাদন বাড়াতে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহ দেওয়া উচিত।

গত অর্থবছর দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ছিল প্রায় ২৯ লাখ টন। এর মধ্যে আমদানি করা হয় ১১ লাখ ৩৬ হাজার টন, যা সবই আনা হয় ভারত থেকে। এর কারণ হলো, ভারত থেকে খুবই কম সময়ে এবং কম খরচে সারা বছরই পেঁয়াজ আমদানি করা যায়। ভারত রপ্তানি বন্ধের পর ব্যবসায়ীরা বিকল্প বাজারে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

শীর্ষে মেঘনা, বিএসএম, এস আলম ও সিটি
ভারত রপ্তানি বন্ধের আগে স্থলবন্দরকেন্দ্রিক পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানি করতেন। রপ্তানি বন্ধের পর সংকট শুরু হলে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো আমদানিতে যুক্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ এনেছে মেঘনা গ্রুপ। তারা তুরস্ক থেকে ৯ হাজার ৩৯৪ টন পেঁয়াজ এনেছে। উড়োজাহাজেও পেঁয়াজ এনেছে তারা।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের অনুরোধে এবং দেশের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পেঁয়াজ এনে
প্রতি কেজি ৩৯ টাকায় সরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছি।’

পেঁয়াজ আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপ। সমুদ্রপথে তাদের পেঁয়াজের চালান প্রথম বন্দরে এসে পৌঁছায়। তারা এনেছে ৫ হাজার ৯৬৬ টন। গ্রুপটি চারটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছে। ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস থেকে প্রথমবার দেশে পেঁয়াজ এনেছে তারা। এই গ্রুপও কিছু পরিমাণ পেঁয়াজ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির কাছে ক্রয়মূল্যে হস্তান্তর করেছে।

বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানিতে অভিজ্ঞতা ছিল না। সংকটের সময় সরকারের অনুরোধে আমদানি করেছি। আমদানি বাড়ার কারণেই কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে এসেছে। তবে আমদানি নয়, নিজেরা উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া জরুরি।’

পেঁয়াজ আমদানিতে ৬০ হাজার টনের ঋণপত্র খুলে আলোচনায় আসে এস আলম গ্রুপ। তবে গ্রুপটি এখন পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তারা বন্দর দিয়ে এনেছে ৫ হাজার ৬১ টন। সমুদ্রপথে আনতে দেরি হওয়ায় উড়োজাহাজে করে শুরুতে পেঁয়াজ এনেছিল গ্রুপটি।

জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান মহাব্যবস্থাপক আখতার হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজ ক্রয়মূল্যে টিসিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জনগণের কষ্ট লাগব করতে গ্রুপটি পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয় বলে জানান তিনি। এ ছাড়া চতুর্থ অবস্থানে থাকা সিটি গ্রুপ তুরস্ক ও চীন থেকে এনেছে ২ হাজার ৮৬৭ টন।

সরবরাহ বাড়াচ্ছে ছোটরাও বড় চারটি শিল্পগোষ্ঠী যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করেছে, একই পরিমাণ পেঁয়াজ এনেছেন ১৩৪ জন ছোট আমদানিকারক। তাঁদের কেউ কেউ এক কনটেইনার (২৮ টন) পেঁয়াজও এনেছেন। কেউ-বা এনেছেন ১০-১২ কনটেইনারও। বাজারে সরবরাহ
সচল রেখেছেন তাঁরাও। ছোটদের পাশাপাশি মাঝারি পর্যায়ের ২০ জন আমদানিকারক এনেছেন ১৬ হাজার টন পেঁয়াজ।

বিকল্প বাজারে শীর্ষে মিয়ানমার
চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে একই সময়ে মিয়ানমার থেকে ৬৮ হাজার ১৮১ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। উড়োজাহাজে করে তুরস্ক, মিসর ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয় ১ হাজার ৬৭ টন। এ নিয়ে ভারতের বিকল্প ৮টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার টন।

বিকল্প বাজারের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মিয়ানমার। রপ্তানি বন্ধের পর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটি থেকে ৬৯ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যা মোট আমদানির ৫৩ শতাংশ। সিংহভাগই টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে এনেছেন দুই শতাধিক আমদানিকারক। সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় ঋণপত্র না খুলে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রলারে করে পেঁয়াজ আনা যায় দেশটি থেকে। ছোট ব্যবসায়ীরাই দেশটি থেকে পেঁয়াজ এনেছেন।

বিকল্প বাজারের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান তুরস্কের। দেশটির বন্দর থেকে পেঁয়াজ জাহাজে বোঝাই করার পর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে গড়ে ২৫ দিন সময় লাগে। ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ আনতে এক মাস বা তারও বেশি সময় লেগেছে। এর পরের অবস্থান যথাক্রমে চীন, মিসর, পাকিস্তান ও নেদারল্যান্ডস।

হাজে বোঝাইয়ের পর চীন থেকে ২০-২২ দিন, মিসর থেকে ২৬-২৭ দিন, পাকিস্তান থেকে ২০-২১ দিন এবং নেদারল্যান্ডস থেকে ৩৩-৩৫ দিন সময় লেগেছে। দেশে আসা পেঁয়াজের কনটেইনার অনলাইনে অনুসরণ (ট্র্যাকিং) করে সময়ের এই হিসাব পাওয়া গেছে।