করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীন থেকে পণ্য আসতে বিলম্ব হতে পারে

চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। ছবি: রয়টার্স
চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীন থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চে যেসব পণ্য বাংলাদেশমুখী জাহাজে বোঝাই করার কথা, তা অন্তত ১০ দিন পিছিয়ে গেছে। চীনে নববর্ষের ছুটি আরও বাড়ানো হলে এই সময় আরও পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাতে কিছুদিন পর উৎপাদন খাত থেকে শুরু করে প্রকল্পকাজ ব্যাহত হতে পারে।

তবে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আসছে চীন থেকে, যেগুলোর প্রক্রিয়া শুরু হয় নববর্ষের ছুটির আগে। চীন থেকে পণ্য আমদানিতে ১৪ থেকে ২২ দিন সময় লাগবে। ফলে এখন পণ্য জাহাজীকরণ পিছিয়ে গেলে তার প্রভাব পড়তে শুরু করবে এ মাসের শেষে। চট্টগ্রাম বন্দর, জাহাজ কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। চীন যেসব পণ্য নিজেদের ব্যবহারের জন্য আমদানি করে, সেগুলোর দাম কমছে বিশ্বজুড়ে। আবার যেসব পণ্য রপ্তানি করে, সেগুলোর দাম বাড়ছে। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের বাজারেও পড়েছে।

চীন থেকে গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ১৪ হাজার কোটি) পণ্য আমদানি হয়, যার প্রায় পুরোটাই এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সামান্য পরিমাণ খালাস হয়েছে মোংলা বন্দরে। খোলা জাহাজ ও কনটেইনার জাহাজে এসব পণ্য সরাসরি ও সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে চট্টগ্রামে আনা হয়।

চীন থেকে আমদানি হয় না এমন তালিকা খুবই কম। আসবাব খাতের স্ক্রু ড্রাইভার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও তিন-চারটি মসলা এমন পণ্যের সংখ্যা অসংখ্য। প্রতিবছর নববর্ষের ছুটির আগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির কাজ গুছিয়ে নেন চীনারা। এরপর ছুটি শেষে শুরু হয় নতুন রপ্তানি আদেশ নেওয়ার কাজ। ছুটি বাড়ানোর পর এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

>

স্ক্রু ড্রাইভার থেকে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্যসহ মসলাও আসে চীন থেকে।

চীনের অনলাইন ‘চায়না ব্রিফিং’-এর তথ্য অনুযায়ী, চীনের স্টেট কাউন্সিল নববর্ষ উপলক্ষে ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি ছুটি ঘোষণা করেছিল। তবে করোনাভাইরাসের কারণে প্রথমে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। ১ ফেব্রুয়ারি আরেক নোটিশে বেশির ভাগ প্রদেশে এই ছুটি ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যেসব প্রদেশে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেখানে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। যেমন হুবেই প্রদেশে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ঝিঝিয়ান প্রদেশে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। কয়েকটি প্রদেশে অবশ্য সীমিত আকারে কাজ হচ্ছে।

বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই ভাইরাসের প্রভাবে আমদানি পণ্য জাহাজে তোলার সময় অন্তত ১০ দিন পিছিয়ে গেছে। চীন থেকেই যেহেতু বাংলাদেশের পোশাক খাতের কাঁচামাল সিংহভাগ আমদানি হয়, সে কারণে এসব পণ্য নির্ধারিত সময়ে আসছে না। এর প্রভাব প্রথমে উৎপাদনে পড়বে। এরপর কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি পিছিয়ে যাবে। তাতে পুরো সরবরাহব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তা এস এম আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাপড়ের একটি চালান মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাহাজীকরণের কথা ছিল। সেটি এখনই ১০ দিন পিছিয়ে মার্চের মাঝামাঝি জাহাজীকরণ করা হবে বলে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেহেতু বৈশ্বিক সমস্যা, সে কারণে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভর করছে এটি।

প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আসছে, শঙ্কা সামনে
দেশে এখন যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার সিংহভাগেরই যন্ত্রপাতি চীন থেকে সমুদ্রপথে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। ছয়টি কোম্পানির জাহাজে এসব প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নিয়মিত আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীন থেকে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নিয়ে পাঁচটি জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছাবে। চীনের বন্দরেও এখন জাহাজে বোঝাই হচ্ছে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি।

চীনের কিন হুয়ান ডাও বন্দরে ‘এমভি শিং ফু সং’ জাহাজে এখন বোঝাই হচ্ছে বাংলাদেশমুখী পণ্য। পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি বোঝাই চলছে জাহাজটিতে।এই জাহাজ আরও দুটি বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে সিঙ্গাপুর হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা। একইভাবে বাও রিসোর্স জাহাজও চীনের বন্দরে বোঝাই শেষে চট্টগ্রামে ফিরবে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে।

চীন থেকে পণ্য আনা এই দুটি জাহাজের স্থানীয় প্রতিনিধি কসকোল ও ইনস্কেপ শিপিং লাইনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব পণ্য আগে থেকে বন্দরে এনে রাখা হয়েছে, সেগুলো এখন জাহাজে বোঝাই হচ্ছে। বর্ধিত ছুটি শেষে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলে চীনারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এ সময় কারখানা সচল না হলে বড় প্রভাব পড়বে। নতুন চালানের পণ্য আসতেও দেরি হবে।’

দাম বাড়ছে মসলার
চীন থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি হয় কম। শুধু রসুন, আদা ও দারুচিনি—এই তিনটি মসলা আমদানি হয়। এই তিনটির সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে পেঁয়াজ। রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে সমুদ্রপথে আমদানি হওয়া রসুন শতভাগই আসে চীন থেকে। গত অর্থবছর বন্দরটি দিয়ে চীন থেকে ৬৪ হাজার ৭৯৬ টন রসুন আমদানি হয়। এবার নববর্ষের ছুটি শুরু হওয়ার আগের মাসে ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ রসুন আমদানি করেছেন। গত ডিসেম্বরে সাড়ে ১৮ হাজার টন রসুন আমদানি হয়। এরপরও করোনাভাইরাসের অজুহাত তুলে রসুনের দাম কেজিতে ৪৫ টাকা বেড়ে ১৭০ টাকায় উঠেছে পাইকারি বাজারে।

রসুনের মতো বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া আদার ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে। ভাইরাসের অজুহাতে আদার দামও বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। এ ছাড়া দারুচিনি আমদানির ৬৭ শতাংশই আসে চীন থেকে। বাকিটা ভিয়েতনাম থেকে। ভাইরাসের অজুহাতে এই পণ্যেরও দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। মসলা ছাড়া ৭০ শতাংশ আপেল আমদানি হয় চীন থেকে।

খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চীনের রপ্তানিকারকেরা ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে সব সচল হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। ছুটি আবার বাড়লে সমস্যায় পড়তে হবে।

দাম কমছে যেসব পণ্যের
চীন নিজেদের ব্যবহারের জন্য যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলোর দাম বিশ্বজুড়ে কমছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চীনের জনসংখ্যা ১৪৩ কোটি। তারা যদি কোনো পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দেয়, তাহলে বৈশ্বিক বাজারও টালমাটাল হবে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ভোজ্যতেলের দামে। বিশ্বে ভোজ্যতেল আমদানিকারকের তালিকায় চীন শীর্ষে। ভাইরাসের প্রভাবে সেখানে আমদানি ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় ইতিমধ্যে পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টনে ৯০ ডলার বা কেজিতে সাড়ে ৭ টাকা কমেছে। মালয়েশিয়ার পাম তেলের দাম টনে ৮১৫ ডলার থেকে কমে ৭২০ ডলারে নেমেছে। একইভাবে সয়াবিনের দাম ৯০০ ডলার থেকে কমে ৮১০ ডলারে নেমেছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকায় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে কেজিতে ১২ টাকা কমে পাম তেল বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে সয়াবিন তেল ৯ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। দাম কমায় সাময়িকভাবে ভোক্তাদের স্বস্তি হলেও ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ছেন।