'ভালো অর্থনীতি' হঠাৎ এক দিনেই খারাপ

>এক দিন আগেই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, একটি সূচক ছাড়া অর্থনীতির অবস্থা ভালো। এক দিন পরেই অবশ্য আগের বক্তব্য থেকে সরে এলেন তিনি।
আ হ ম মুস্তফা কামাল
আ হ ম মুস্তফা কামাল

এক দিনের মধ্যেই ‘ভালো’ অর্থনীতি খারাপ হয়ে গেল। আর এর মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল স্বীকার করে নিলেন যে দেশের অর্থনীতি এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তিনি আরও মানলেন যে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুব ভালো নয় এবং আমদানি-রপ্তানির চিত্রও নেতিবাচক।

অর্থমন্ত্রী অবশ্য এক দিন আগেও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘একমাত্র রপ্তানি বাণিজ্য নেগেটিভ। এটা ছাড়া একটি খাতও নেই, যেখানে আমরা পিছিয়ে আছি।’

অর্থমন্ত্রী এই বক্তব্য দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান দিচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য। সরকারি এই তিন সংস্থার দেওয়া তথ্য বরং বলছে, কেবল একটি সূচকই ভালো আছে, বাকি সব সূচকই নিম্নগামী।

এক দিনের মধ্যেই উপলব্ধি পরিবর্তনের কারণ অবশ্য অর্থমন্ত্রী জানাননি। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি অর্থনীতি নিয়ে দুই দফা বক্তব্য দিয়েছেন। আর সেখানেই তিনি স্বীকার করে নেন যে অর্থনীতি ভালো অবস্থায় নেই। তবে তিনি আশাবাদী যে চলতি বছর শেষে এই খারাপ অবস্থা থাকবে না। কীভাবে থাকবে না, তার অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভালো দিক যে অর্থমন্ত্রী অন্তত স্বীকার করেছেন, অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। তবে বছর শেষে তা ভালো হয়ে যাবে, মুখে বললেই তা বিশ্বাস করা যাবে না। কাজে প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করার আগে সরকারের মনটা ঠিক করতে হবে। তারপর স্বজনতোষী মনোভাব পরিহার করতে হবে। 

খেলাপি ঋণ কেন বাড়ছে

রাজধানীর মতিঝিলে গতকাল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ‘শাখা ব্যবস্থাপকদের বার্ষিক কার্যক্রম প্রণয়ন সম্মেলন ২০২০’–এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় তিনি খেলাপি ঋণ যে বাড়ছে, সে কথাও বলেছেন। অর্থমন্ত্রীর এই উপলব্ধি অবশ্য গতকালের নয়, বরং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার ১১ মাস পরে গত ডিসেম্বরে প্রথম এ কথা মেনে নিয়েছিলেন। তার আগ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে বলে আসছিলেন যে খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তিনি যতই এ কথা বলছিলেন, ততই খেলাপি ঋণ বাড়ছিল। সেই পরিসংখ্যানের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার পরেই তিনি খেলাপি ঋণ না বাড়ার বক্তব্য থেকে সরে এসেছিলেন। 

গতকালের বৈঠকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য অর্থমন্ত্রী অবশ্য ব্যাংকারদের দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও খুব ভালো নয়। ব্যাংকগুলো যদি ভালো চলত, তবে এগুলোকে একীভূত করতে হতো না। ব্যাংক খাতে অনেক অসংগতি আছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।’ ব্যাংকারদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘আপনাদের কারণে জাতীয় সংসদে আমাকে গালি শুনতে হচ্ছে। আপনারাই বলেন, এটা কি আমার জন্য হয়েছে, না আপনাদের জন্য?’ অর্থমন্ত্রী অবশ্য এ–ও বলেন, ব্যাংকাররা সবাই খারাপ নন, কিছু লোক খারাপ। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ব্যাংকারদের উচিত হবে নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের ব্যবস্থা নেওয়া।

অর্থমন্ত্রী কেবল ব্যাংকারদের দায়ী করলেও অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা অবশ্য এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করেন না। ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ দেওয়া, নজরদারির অভাব, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকেও দায়ী করেন তাঁরা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী হিসেবে অর্থমন্ত্রী মূলত ব্যাংকের মালিকপক্ষের স্বার্থে অবস্থান নিয়েছেন। মালিকদের কথা উপেক্ষা করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কখনোই ঋণ দিতে পারে না, তা সে সরকারি-বেসরকারি যে ব্যাংকই হোক না কেন। সুতরাং কেবল ব্যাংকারদের ওপর দোষ চাপিয়ে মালিকপক্ষকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার ইঙ্গিত ঠিক ভালো লাগছে না। 

খারাপ আছে সবাই

সকালের সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কথা বলেছেন রপ্তানি বাণিজ্য নিয়েও। তাঁর মতে, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আমদানি-রপ্তানি ঠিকভাবে হচ্ছে না।

আবার গতকালই বিকেলে তিনি সচিবালয়ে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। তখন তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে ৬, মালয়েশিয়ায় ২ দশমিক ৫, ভিয়েতনামে ১৪ দশমিক ৩, ইংল্যান্ডে ৩ দশমিক ৩, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১ দশমিক ৮ এবং ভারতে ৩ দশমিক ১ শতাংশ রপ্তানি আয় কমেছে। বাংলাদেশেও রপ্তানি কমেছে। আর এটা বাস্তবতা। 

রপ্তানি বাণিজ্য ছাড়াও অর্থমন্ত্রী অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলেছেন। কেননা, পাচার বাড়ছে বলে গত বুধবার সংসদে বিরোধী দলের একাধিক সদস্য সমালোচনা করেছিলেন। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বুধবারের সংসদ আলোচনায় একটি বিষয়ই উঠে আসে যে ব্যাংক খাতের দুর্বল অবস্থা এবং অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। পরিমাণও দিয়ে দিলেন তাঁরা। সংসদে এভাবে বললে দেশবাসী বিশ্বাস করেন। আমার প্রশ্ন, এত অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, কীভাবে জানলেন?’ 

এ বিষয়ে অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী এই তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সর্বশেষ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১০ বছরে (২০০৬ থেকে ২০১৫) বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন শ্লথ এবং এর একটা প্রভাব আমাদের ওপর পড়বেই। কিন্তু অনেক বিষয় আছে, যেগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেগুলো নিয়েও আমরা কোনো ভালো কিছু করতে পারছি না। যেমন অবকাঠামো খাতের অনেক বড় বড় প্রকল্প চলছে। এ জন্য সরকারের টাকার অভাব হতো না যদি ঢাকা চেম্বারের প্রস্তাব অনুযায়ী অবকাঠামো বন্ড চালু করা হতো। কিন্তু এ নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।’

ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ

বুধবার জাতীয় সংসদে স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিলের একাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেওয়ার ব্যাপারে উত্থাপিত বিলের ওপর বিরোধী দলের সাংসদেরা যে সমালোচনা করেন, তাতে তিনি আহত হয়েছেন বলে গতকাল জানান। 

অর্থমন্ত্রী বলেন, সংসদে বিরোধী দলের সাংসদেরা বিলের ওপর আলোচনায় সমালোচনা করলেও জাপার সাংসদ ফখরুল ইমাম ৬১টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও ১৯টি, আরেকজন আরও ১১টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি এ নিয়ে বলেন, ‘তাঁরা নিজেরাই প্রস্তাব করেছেন, আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। মনের আনন্দে কেউ কেউ বলেছিলেন, আরও প্রতিষ্ঠানকে এর আওতায় আনতে হবে। কিন্তু পরে আবার তাঁরাই বিরোধিতা শুরু করলেন। এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’ 

বিরোধী দলের সাংসদদের প্রতি ইঙ্গিত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একজন বলেছেন, আমি ব্যবসায়ী মন্ত্রী, ভালো ছাত্র ছিলাম। ব্যবসায়ী ছিলাম, এটা ঠিক। পেশাগত পরিচয় ছিল আমার। অন্য ব্যবসাও ছিল। আমি সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ (সিএ) ছিলাম। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানও সিএ ছিলেন। কিন্তু আমি ব্যবসায়ী ছিলাম ১২ বছর আগে। ব্যবসা করা তো অপরাধ না।’

সংসদে বুধবার নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘আমি কখনোই তা হারাই না। সামান্য সময়ের জন্য ওই দিন তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি যে সারা বিশ্বের অর্থমন্ত্রীদের সেরা, এটা তাঁরা একবারও বলেননি।’

সংস্থার অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেওয়ার আইনটি কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি এবং অর্থনীতিতে এই আইন অর্থবহ ভূমিকা রাখবে—এমন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সংস্থাগুলোতে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেই এটি করা হয়েছে। টাকা দেওয়ার সময় সরকার দেবে আর খরচ করার সময় সংস্থা নিজে—এটা হওয়া উচিত নয়।

আইন কার্যকর হলে ৬১ সংস্থা থেকে কত টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যেতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ হিসাব এখনো করা হয়নি।’ কোষাগার থেকে টাকা পরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হবে কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোথায় রাখা হবে, তা পরে জানা যাবে।’ তবে অর্থমন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক ভালো যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলো উল্টো দিকে হাঁটছে। সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তি খাত বঞ্চিত থাকছে। অন্যদিকে আছে অপচয়। উন্নয়নের নামে এমন সব কর্মসূচি আছে, যেগুলো বাস্তবায়িত না হওয়াই ভালো।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে রপ্তানি কমলেও আমাদের মতো অপচয় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তারা নেই বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কমছে। এই যে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) আসি আসি করেও আসছে না। এগুলোর পেছনে কায়েমি স্বার্থ রয়েছে। এসব বন্ধ করতে না পারলে বছর শেষে ভালো কিছুর জন্য আশান্বিত হতে আমাদের দ্বিধা হয়।’