করোনার কোপে কাটছে কত কী

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।
>এয়ারক্র্যাফট থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, পর্যটন খাত—সবই করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন বিপর্যয়ের মুখে।

চীন থেকে করোনাভাইরাস দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সর্বত্র যেমন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, তেমনি প্রযুক্তি ও পর্যটন খাত থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার, অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি বা গাড়িশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ-ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের প্রবৃদ্ধি কমবে। আবার বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে

বিশ্বখ্যাত বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস চীনের তিয়ানজিনে অবস্থিত তাদের কারখানার উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে বিশ্বে জেট বিমান সরবরাহে প্রভাব পড়বে। কারণ, ওই কারখানায় এয়ারবাস মাসে ছয়টি এ৩২০ এয়ারক্র্যাফট তৈরি করে থাকে।

জাপানি টয়োটা ও হোন্ডা, মার্কিন জেনারেল মোটরস ও জার্মানির ফক্স ওয়াগন ও বিএমডব্লিউর মতো বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতারাও চীনে তাদের কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

চীন থেকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ না আসায় দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাইও তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।

জাপানের অর্থমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরার মতে, করোনাভাইরাসের কারণে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও মুনাফা কমবে। যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানি জিএসকে জানিয়েছে, চীনের তিয়ানজিনে তাদের যে কারখানা আছে, সেটি চীনা নববর্ষের লুনার ইয়ারের ছুটির পর থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। চীনে জিএসকেতে তিন হাজার চীনা নাগরিক কাজ করেন।

প্রহেলিকায় প্রযুক্তি ব্যবসা

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান থেকে বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ নিয়ে থাকে। কিন্তু অ্যাপলের আইফোন সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান বা অ্যাসেম্বলার ফক্সকন ও পেগাত্রন মধ্য জানুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীন থেকে স্মার্টফোনের সরবরাহ ৪০ লাখ কমবে।

মিকি অ্যান্ড মিনি মাউসসহ চীনে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব থিম পার্ক রয়েছে, সেগুলোও এখন বিরান পড়ে আছে। এর মধ্যে ডিজনি জানিয়েছে, থিম পার্ক বন্ধ রাখার কারণে তাদের পরিচালন আয় ২৮ কোটি মার্কিন ডলারের মতো কমতে পারে। চীনে থিম পার্কগুলো অন্তত দুই মাস বন্ধ রাখতে হবে বলে ধারণা করা হয়েছে।

বিপদে আছে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো

করোনার প্রভাবে চীনের বাজারে বিভিন্ন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। নাইকি তো ইতিমধ্যে চীনে তাদের অর্ধেকের মতো স্টোর বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি স্টোর খোলা রাখার সময়ও কমিয়েছে। তাদের মোট বৈশ্বিক বিক্রির মধ্যে চীনেই হয়ে থাকে ১৭ শতাংশ।

নাইকির ব্যবসায়িক প্রতিযোগী অ্যাডিডাসও তাদের প্রচুর আউটলেট বন্ধ করেছে। এ ছাড়া এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ ও হুগো বসের মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোও চীনে তাদের স্টোর অর্থাৎ বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে।

আইকিয়া চীনে তাদের সব কটি স্টোর, ফাস্টফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস ৩০০ রেস্তোরাঁ এবং স্টারবাকস ২ হাজার ১০০ ক্যাফে বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের বাজারে অ্যাস্টন মার্টিন ও জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) দ্রুত বিক্রয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এলেও এখন করোনার কোপে থেমে গেছে। জেএলআরের মূল কোম্পানি ভারতের টাটা মোটরস জানায়, এই গাড়ি বিক্রির ১৭ শতাংশ বা ১ লাখ বিক্রি হয় চীনে।

দামি মদের ব্র্যান্ড দায়াজিও ও রেমি কয়েনত্রিয়াউ তাদের ব্যবসা কমার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র বাজার চীনে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ খাতে দেশটি ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে।

পর্যটন খাত

বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। চীনে ঢোকা বা চীন থেকে বের হওয়া এখন কার্যত বন্ধ রয়েছে। যাত্রী কমার কারণে কয়েকটি বিমান সংস্থা চীনে ফ্লাইট বা উড্ডয়ন কার্যক্রম বন্ধ করেছে, কমিয়েছে এবং নিজেদের কর্মীদের ছুটিতে পাঠিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনাদের জাপান, যুক্তরাজ্যসহ বিদেশ ভ্রমণ বাড়লেও এবার তাতে বিপর্যয় নেমেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে চীনসহ যুক্তরাজ্য, জাপান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ পর্যটন খাতে প্রচুর অর্থ উপার্জনকারী বিভিন্ন দেশে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

এখন শুধু খোলার অপেক্ষায়

এদিকে বিশ্ব এখন চীনে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বিশেষ করে বন্ধ কারখানাগুলো আজ সোমবারের মধ্যে খুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে। তা না হলে প্রযুক্তি, অটোমোবাইলসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ব্র্যান্ড চীনে উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, চীন এরই মধ্যে ফ্যাক্টরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা বিশ্বের কারখানা নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক বাজারে স্মার্টফোন সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটবে; জানুয়ারি-মার্চ সময়ের মধ্যে চীনা স্মার্টফোন বিক্রি ৪০ লাখ কমবে এবং পুরো বছরে (২০২০) ৩২ শতাংশ কমবে।

রোবো ব্যাংকের এশিয়া-প্যাসিফিকের হেড অব ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট মাইকেল এভরি বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির হঠাৎ উন্নতি ঘটলেও আমি সত্যি নিশ্চিত যে কারখানা খোলার জন্য সোমবার বাস্তবসম্মত দিন নয়। অনেকেই মনে করেন, এপ্রিল মাসই হতে পারে উপযুক্ত সময়।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসি