কঠিন সময়ে ভালো অর্থনীতি কেমন হতে পারে

‘অর্থনীতিবিদেরা প্রায়শই ভুল করেন, করতে পারেন। এই বইতে আমরা যেমনটা করেছি।’

এভাবেই নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানান দিতে দ্বিধা করেননি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আর এস্তার দুফলো। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমআইটির কৃতী দুই শিক্ষক আরেক কৃতী মাইকেল ক্রেমারের সঙ্গে মিলে গেল বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন। সর্বশেষ বই গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইমস–এ অভিজিৎ-দুফলো (ঘটনাক্রমে যাঁরা স্বামী-স্ত্রী) অবশ্য এ কথাও বলেছেন, ‘শুধু অর্থনীতিবিদেরাই নন, ভুল সবাই করেন। বরং ভয়ের হলো, ভুল না করা আর নিজের মতে অবিচল থাকা। প্রগতির জন্য বারবার আমাদের মূল ঘটনার কাছে ফিরতে হবে। আমাদের ভুলের কথা স্বীকার করতে হবে। আর এগোতে হবে।’

৪০৩ পৃষ্ঠার বইতে এই এগোনোর কথা, ভালো অর্থনীতির কথা বলেছেন দুজন। বলেছেন এমন একটা সময়ে যখন সময়টা, তাঁদের ভাষায় ‘তীব্র মেরুকরণের।’ হাঙ্গেরি থেকে ভারত, ফিলিপাইন থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে ব্রাজিল—এই বিভাজনের চিত্র সর্বত্র। অভিজিৎ-দুফলো যেখানে থাকেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের ৬১ শতাংশ মনে করেন, রিপাবলিকানরা জাতিবিদ্বেষী, লিঙ্গবিদ্বেষী এবং ধর্মান্ধ। আর ৫৪ শতাংশ রিপাবলিকানের চোখে ডেমোক্র্যাটরা হলেন কুঁদুলে। 

এই বিভাজিত, মন্দায় আক্রান্ত বিশ্বের জন্য ভালো অর্থনীতির সন্ধান খুঁজেছেন অভিজিৎ-দুফলো। এ দুই অর্থনীতিবিদের কাজের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার মতোই অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট নীতির কার্যকারিতা নিরূপণ করেন নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার মাধ্যমে। মহান মহান তত্ত্বের উদ্ভাবক না হয়ে অর্থনীতিবিদদের নিজেদের দক্ষ মিস্ত্রি হিসেবে দেখা উচিত—এ দুই অর্থনীতিবিদ এমনটাই ভাবেন। এর আগের বই পুওর ইকোনমিকস বের হয় ২০১১ সালে। বইতে এ দুই অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, এই মিস্ত্রির কাজ কীভাবে কার্যকর হয়। আর এর ফলে উন্নয়নশীল দেশের স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে শুরু করে টিকাদানের হারকেও বাড়াতে পারে। গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইমস আগের বইটির ধারাবাহিকতা। আগের বইটির মূল উপজীব্য ছিল দরিদ্র দেশ, দেশের মানুষের জীবনমান। নতুন বইয়ের পরিসর বৃহত্তর। সেখানে উন্নয়নশীল দেশ আছে বটে, তবে এর পাশাপাশি বড় অংশজুড়ে আছে ধনী দেশের নীতি, এর প্রয়োগ, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম। দুই অর্থনীতিবিদ খুঁজেছেন নানা প্রশ্নের উত্তর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কি সবার জন্য সুফল বয়ে আনে, দরিদ্র দেশের অভিবাসীরা উন্নত দেশে এসে এসব দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের সব কাজ নিয়ে নিচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদের জন্য ভয়ের কারণ, না এর মধ্যে ইতিবাচক কিছু আছে, জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি কেমন হবে—এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক এসব প্রশ্ন আর এর সমাধানের কথা বলেছেন। শুধু নিজেদের কথা বলেননি, সমকালের অর্থনীতিবিদদের কথাও তুলে ধরেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, অতি উন্নত অর্থনৈতিক গবেষণা বড় সমস্যা সমাধান করতে পারে। বাণিজ্যের অভিঘাত সামলানো বা অভিবাসনের একটি সঠিক মান নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমাধানের অর্থনৈতিক গবেষণার কারণে সম্ভব হতে পারে। 

অভিজিৎ-দুফলোর বইতে বাংলাদেশ এসেছে বারকয়েক। এর মধ্যে একটি প্রসঙ্গ এসেছে কার্যকর অর্থনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োগের উদাহরণ টানতে গিয়ে। 

একটি তত্ত্ব বলে, দরিদ্র মানুষ তাদের আত্ম–উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্য কোথাও যেতে পারে না। কারণ, তারা তথ্য পায় না। তবে এর বিপরীতে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, তথ্যই একমাত্র প্রতিবন্ধকতা নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের মঙ্গা–আক্রান্ত মানুষকে বাইরে কাজের ক্ষেত্রে পাঠানোর ব্যাপারে দুই ধরনের পদ্ধতি নেওয়া হয়। প্রথম একটি দলকে বাইরে কাজের ব্যাপারে শুধু তথ্য দেওয়া হয়, আরেকটি দলকে তথ্যের পাশাপাশি কিছু টাকা ধরে দেওয়া হয়। এ টাকা দেওয়া হয় ঋণ হিসেবে। দেখা গেছে, অর্থ পাওয়া মানুষদের মধ্যেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র কাজের জন্য ছুটে গেছেন বেশি। তাঁরা বেশি পরিমাণে টাকা পাঠিয়েছেন। আর এই অর্থ পাওয়া পরিবারগুলোর ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণও বেশি। 

বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আবার এসেছে এখন বহুল চর্চিত প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ বিল এস্টারলির গবেষণা তুলে ধরে এই দুই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, প্রবৃদ্ধি এমন এক বিষয়, যা একটি দেশের ক্ষেত্রে একেক দশকে ভিন্ন রকম হতে পারে। ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকের বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির দৌড়ে এগিয়ে থাকা ব্রাজিলের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ে আশির দশকে এসে। আবার ২০০০ সালে এসে আবার দেশটি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায়, ১৯৭০ এর দশকের ‘বাস্কেট কেস’ বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ২০০০ অবধি ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটে। ২০১৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এর হার ৭ শতাংশ পৌঁছায়। বিশ্বের ২০টি বড় প্রবৃদ্ধির দেশের মধ্যে একটিতে পরিণত হয় দেশটি। 

বইপত্রে যেমনভাবে উঠে আসে, তার চেয়ে ‘বাস্তবে এ বিশ্ব এক জটিল জায়গা’—স্বীকার করেন অর্থনীতিবিদেরা। আর এখানে চলে ভালো ও খারাপ অর্থনীতির দ্বন্দ্ব। তাঁরা বলছেন, ‘অর্থনীতি বিদ্যার চোখে এ বিশ্ব এক অদম্য গতিশীল বিষয়। এখানে মানুষ উদ্দীপিত হয়, চাকরির পরিবর্তন করে, যন্ত্র বানানো ছেড়ে কেউ সংগীত শেখে। নতুন ব্যবসায়ের শুরু হয়, এর উত্থান ঘটে, আবার সেটার অবসান হয়। পুরোনো কোনো ধারণা নতুন ধারণার কাছে পরাজিত হয়। ম্যানচেস্টারের কারখানার কোনো পণ্য মুম্বাইয়ে আসে, আবার সেখান থেকে মিয়ানমার হয়ে হয়তো একদিন মোম্বাসা বা মোগাদিসুতে চলে যায়।...সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সুযোগ। দরকারটা হলো তারেই খুঁজে বের করা, যার সেটা প্রয়োজন।’

বইটির শেষ কথা হলো, ‘ভালো অর্থনীতি কেবল আমাদের রক্ষা করতে পারে না। তবে এটা ছাড়া আমরা পুরোনো ভুলগুলো আবার করতে থাকব। খারাপ ধারণার বিরুদ্ধে সজাগ থাকা, প্রশ্ন তোলা, ধৈর্যশীল থাকা এবং আমাদের জ্ঞাত বিষয়ে সৎ থাকা। এই সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি যদি না থাকে, তবে বৃহত্তর সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজার চেষ্টা শুধু স্লোগানসর্বস্ব হয়ে থাকবে।’

 অভিজিৎ-দুফলোর কথা, ‘আর এ কাজের আহ্বান শুধু যাঁরা অর্থনীতিবিদ, তাঁদের জন্যই নয়। এটা সবার জন্য, যাঁরা একটা উন্নততর, বিবেকবান, অধিক মানবিক সমাজ চান।’

ভালো অর্থনীতির সন্ধানদাতারা অবশ্য আবারও স্বীকার করেন, ‘অর্থনীতি এত জরুরি বিষয় যে তা শুধু অর্থনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।’