বাংলাদেশে দায়িত্বে বাংলাদেশের মেয়ে

স্বপ্না ভৌমিক, কান্ট্রি ডিরেক্টর,  মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। ছবি: সাইফুল ইসলাম
স্বপ্না ভৌমিক, কান্ট্রি ডিরেক্টর, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। ছবি: সাইফুল ইসলাম

বাবা রতন কুমার ভৌমিক চাইতেন, মেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করুক। আর মেয়ের আগ্রহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শেষ পর্যন্ত মেয়ে স্বপ্না ভৌমিকের জেদের কাছে হার মানলেন বাবা। অবশ্য অমত থাকলেও বিভাগটি, অর্থাৎ মেয়ে কোন বিষয়ে পড়বে, সেটি নিজেই ঠিক করে দিলেন। দর্শনে ভর্তি হলেন স্বপ্না। অনার্সের শেষ বর্ষে এসে হঠাৎ করেই রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলো। নিজে নিজেই বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভর্তি হয়ে গেলেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি)। 

বিইউএফটির ডিপ্লোমা কোর্সে ভালো ফলের সুবাদে স্বপ্না ডাক পেলেন দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে। তত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাও শেষ। গার্মেন্টসে কাজ করবেন কি করবেন না, এমন দোটানার মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন। প্রথম দিন কারখানায় পরিদর্শনে গিয়েই ধাক্কা খেলেন স্বপ্না। নারী পোশাকশ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো বাথরুম নেই। পুরুষদের বাথরুমই ব্যবহার করতে হতো তাঁদের। বড় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সুপারভাইজার বা ব্যবস্থাপক পদে কোনো নারী নেই। নারীদের জন্য কিছু করার তাগিদে সেদিনই স্বপ্না চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন—পোশাকশিল্পেই কাজ করবেন।

সেই স্বপ্না ভৌমিক বর্তমানে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের (এমঅ্যান্ডএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর বা বাংলাদেশের প্রধান। ২০১৩ সালে যখন তিনি দায়িত্বটি নেন, তখন ব্র্যান্ডটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করত ১৩ কোটি ডলারের পোশাক। সেই পোশাক সরবরাহ করত ৩০টি কারখানা। স্বপ্নার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই ফ্যাশন ব্র্যান্ড। গত বছর এমঅ্যান্ডএস বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ৩০ থেকে বেড়ে ৬০-এর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে।

একজন সহকারী মার্চেন্ডাইজার থেকে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের বাংলাদেশি প্রধান হওয়ার গল্প শুনতে গত মাসের এক সকালে আমরা হাজির হই এমঅ্যান্ডএসের ঢাকা কার্যালয়ে। সেদিন ঘণ্টাখানেকের আলাপচারিতায় স্বপ্না ভৌমিক দিলেন বেশ কিছু মজার তথ্য। বললেন, ‘ছোটবেলায় আমি জানতাম না, বড় হয়ে কী হব। তবে একটি বিষয়ে পরিষ্কার ছিলাম, আমি পরিবর্তন চাই। সেটি যেখানেই হোক। জীবনে যা–ই করি না কেন। যদি আমি ছোটা বুয়াও হই, তাহলেও শ্রেষ্ঠ ছোটা বুয়া হব।’ 

ছোটবেলার গল্প

মাগুরার নতুন বাজারে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন স্বপ্না ভৌমিক। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। একপর্যায়ে বদলি হলেন বগুড়ায়। সঙ্গে পরিবারও থিতু হলো সেখানে। পুলিশ লাইন হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন স্বপ্না। পরে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি। 

স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘বগুড়ায় সরকারি কলোনিতে আমরা থাকতাম। খুবই সুন্দর সময় ছিল। আমি আর বাবা বাগান করতাম। এক পাশে ফুল আর অন্য পাশে সবজি লাগাতাম। কলোনিতে আমরা যারা একটু বড় ছিলাম, তাদের দায়িত্ব ছিল ছোটদের সঙ্গে খেলাধুলা করা আর তাদের পড়ানো। আজকালের মতো প্রাইভেট টিউটরের বিষয়টি ছিল না। আমরা বড়রা গ্রুপ করে পড়তাম। বাবার সঙ্গে প্রতিদিনই কলোনির পাশের বাজারে যেতাম। তখন থেকেই মানুষের সঙ্গে মেশার অভ্যাসটি তৈরি হয় আমার।’ 

নেক্সট ও ওয়ালমার্টে চার বছর

রেনেসাঁ গ্রুপ দিয়ে পোশাকশিল্পে কর্মজীবন শুরু করেন স্বপ্না ভৌমিক। প্রতিষ্ঠানটিতে দুই বছর কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল। হেড অফিসে কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে চার দিনই আমাদের কারখানায় যেতে হতো। কারখানার পরিবেশ তখনো সে রকম উন্নত ছিল না। তবে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন, তারপর পোশাক তৈরি, মেশিনপত্র কিংবা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা—সবকিছুতে আমি অন্য রকম আনন্দ পেতাম। সকালে বের হতাম আর কাজ শেষে রাতে বাসায় ফিরতাম। সব মিলিয়ে ১৮-১৯ ঘণ্টা কাজ করতাম।’ 

২০০২ সাল। হঠাৎ একদিন ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড নেক্সটের কাছ থেকে ফোন পেলেন স্বপ্না। তারা জানতে চাইল, নেক্সটে কাজ করতে স্বপ্না আগ্রহী কি না। সাতপাঁচ না ভেবে সহকারী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগ দিলেন স্বপ্না। সেখানে দেড় বছর পর কাজ করার পর মার্কিন খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড ওয়ালমার্ট থেকে ডাক এল। বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ সব সময়ই ছিল। ফলে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগ দিলেন স্বপ্না।

২০০৬ সালে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার থেকে ফোন কল পেলেন। তখন ঢাকায় কেবল অফিস স্থাপন করেছে ব্র্যান্ডটি। সেখানে কাজ করেন হাতে গোনা তিন–চারজন। তার তুলনায় ওয়ালমার্ট তখন বেশ বড় কোম্পানি। তারপরও চ্যালেঞ্জ নিলেন স্বপ্না ভৌমিক। বললেন, এমঅ্যান্ডএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ নিয়ে বড়সড় পরিকল্পনা আছে। তাঁদের পরিকল্পনা ও চিন্তাধারা ছিল একটু অন্য রকম। সেখানে কাজ করার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে। তা ছাড়া বিশ্বখ্যাত একটি ব্র্যান্ড বাংলাদেশে নতুনভাবে শুরু করতে চাচ্ছে—বিষয়টি আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা দিল।

ওয়ালমার্টের অফিসে ফিরে স্বপ্না যখন বললেন, তিনি এমঅ্যান্ডএসে যোগ দিচ্ছেন, তখন সহকর্মীদের প্রায় সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে লাগলেন। স্বপ্না ভৌমিক বললেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল কীভাবে ব্র্যান্ডটিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তো সবাইকে বুঝিয়ে আমি মার্চেন্ডাইজার হিসেবে এমঅ্যান্ডএসে যোগ দিলাম।’

এমঅ্যান্ডএসের সঙ্গে পথচলা

এমঅ্যান্ডএসের ঢাকা কার্যালয় তখন ছোট। লোকবল কম। ফলে পোশাকের নকশা উন্নয়ন থেকে শুরু করে ক্রয়াদেশ দেওয়া এবং কারখানায় উৎপাদন পর্যায়েও কাজ করতেন স্বপ্না ভৌমিক। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম বন্দরেও চলে যেতেন। ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা দিয়ে ব্র্যান্ডের কর্তাব্যক্তিদের নজর কাড়লেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে তিনি এমঅ্যান্ডএসের বাংলাদেশের প্রধানের দায়িত্ব পেলেন। তখন বিদেশি ব্র্যান্ড বা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বাংলাদেশি সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। 

স্বপ্না ভৌমিক বললেন, ‘কান্ট্রি ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি দামের পোশাক বানানোর দিকে নজর দিই। বাংলাদেশকে কীভাবে সারা বিশ্বের কাছে গন্তব্য বানাতে পারি, সেই চিন্তাই বেশি ঘুরপাক খেত। তখন আমাদের সরবরাহকারীরা সস্তা পোশাক বেশি পরিমাণে বানাতেন। তাঁদের সমস্ত নজর সেদিকে ছিল। ধীরে ধীরে তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাই। এমঅ্যান্ডএস পণ্যের মানের বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল। সেজন্য জার্নিটা ছিল বেশ কঠিন। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের জন্য মোজা থেকে ব্লেজার পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের পোশাকই প্রস্তুত হয়।’

একসময় এমঅ্যান্ডএসের সব পোশাকই বিদেশি কাপড়ে তৈরি হতো। সে জায়গায় বিরাট পরিবর্তন এনেছেন স্বপ্না ভৌমিক। বর্তমানে ব্র্যান্ডটির জন্য প্রস্তুত হওয়া পোশাকের ৫৫ শতাংশ কাপড় দেশীয় বস্ত্রকল সরবরাহ করছে। তা ছাড়া এমঅ্যান্ডএস সবচেয়ে বেশি ডেনিম বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। আর পোশাকের কথা বললে এমঅ্যান্ডএসের সবচেয়ে বেশি পোশাক প্রস্তুত হয় বাংলাদেশি কারখানায়।

বড় পদে গেলেও নারী শ্রমিকদের কথা ভোলেননি স্বপ্না ভৌমিক। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি নারী নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে ১৫০ জন নারী সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় পদে আছেন। স্বপ্না বললেন, ‘কারখানার ভেতরে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। নেতৃত্বে নারী ও পুরুষের ভারসাম্য থাকলে সেসব সমস্যা সমাধানের কাজটি অনেক সহজ হয়।’

ছেলের সঙ্গে গান গেয়ে স্কুলে

স্বামী অনিন্দ্য চৌধুরী, ছেলে অরিত্র্ চৌধুরী, শাশুড়ি, বাবা-মাকে নিয়ে স্বপ্না ভৌমিকের সংসার। মা অসুস্থ। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। দুই দিন স্বপ্নার ভাই মাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আর রোববার মাকে নিয়ে হাসপাতালে কাটে স্বপ্নার।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করেন স্বপ্না। তারপর নাশতা সেরে ছেলে অরিত্র্য চৌধুরীকে নিয়ে স্কুলে রওনা দেন। স্বপ্না বললেন, ‘আমরা দুজন গান গাইতে গাইতে স্কুলে যাই। এটাই দিনের শ্রেষ্ঠ সময়।’

অবসরে বই পড়তে ভালোবাসেন স্বপ্না ভৌমিক। বললেন, ‘বই পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়ি।’ 

 শেষ কথা

সহকারী মার্চেন্ডাইজার থেকে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের বাংলাদেশ-প্রধান হওয়ার পেছনের মূলমন্ত্র কী জানতে চাইলে স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘আমি প্রতি মুহূর্তে ঠেকে ঠেকে শিখেছি। কখনোই কোনো কাজকে ছোট মনে করিনি। সব সময় আমি আমার কাজটা ঠিকঠাকভাবে করার চেষ্টা করেছি। কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণেই সেটি সম্ভব হয়েছে।’ 

স্বপ্না ভৌমিক আরও বলেন, ‘দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসা টেকসই করার জন্য যা করার দরকার, সব চেষ্টা করেছি। নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের জন্য দিনের পর দিন কারখানার পেছনে লেগে ছিলাম। অবশ্য এজন্য আমার িটমের সবাই আমার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ফলাফল—এমঅ্যান্ডএস বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করেছে। এতে বেশি উপকৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।’

তরুণদের জন্য পরামর্শ

● পোশাক খাতে কাজের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। মানুষকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। 

● কঠোর পরিশ্রম করতে জানলেই স্মার্ট কাজ করতে পারবেন। স্মার্ট কাজ করতে চাইলে আগে কঠোর পরিশ্রম করা শিখতে হবে। 

● গাধার খাটুনি খাটার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। 

● প্রতিদিন জ্যাম ঠেলে কারখানায় যাওয়ার মতো ধৈর্য শিখতে হবে। 

● পোশাকশিল্প–সংশ্লিষ্ট পড়ালেখা থাকলে আপনি এগিয়ে থাকবেন।

● প্রযুক্তির সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকতে হবে। 

একনজরে 

মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার

(যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড) 

প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৮৪ 

প্রতিষ্ঠাতা: মাইকেল মার্কস ও থমাস স্পেনসার

সদর দপ্তর: লন্ডন, যুক্তরাজ্য

বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা: ১৪৬৩ (২০১৯ সাল পর্যন্ত) 

আয়: ১,০৩৭ কোটি পাউন্ড (২০১৯) 

কর্মসংস্থান: প্রায় ৮০ হাজার 

সহযোগী ব্র্যান্ড: পার উনা, অটোগ্রাফ, লিমিটেড, ব্লু হারবার, এমঅ্যান্ডএস ইনার্জি ইত্যাদি