দিন দিন যাত্রী বাড়ছে, ভাড়াও কমছে

প্র বাণিজ্য: বাংলাদেশে বেসরকারি এয়ারলাইনের ব্যবসার অবস্থা কেমন?

মফিজুর রহমান: খারাপ না। আবার খুব ভালোও না। খারাপ নয় এ কারণে যে দিন দিন যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে, আর ভালো নয়, কারণ দিন দিন ভাড়া কমে যাচ্ছে। তাতে অপারেশন ব্যয় উঠে আসছে না।

প্র বাণিজ্য: যাত্রী তো দিনে দিনে বাড়ছে।

মফিজুর রহমান: এ কথা ঠিক যে যাত্রী বাড়ছে। ২০০৯ থেকে যাত্রী ভালোই বাড়ছিল। এবার কিন্তু যাত্রী কমে যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা লক্ষ করছি যাত্রী কমে যাচ্ছে।

প্র বাণিজ্য: কেন কমে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আপনাদের কি কোনো ধারণা আছে?

মফিজুর রহমান: অনেক কারণ আছে। যেমন সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিল ঢাকা-চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামে এখন বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লাগে। মানুষ এত ঝক্কি নিতে চায় না। তার চেয়ে সড়ক যোগাযোগ ভালো হয়ে গেছে। যাঁরা উড়োজাহাজে যেতেন, তাঁরা এখন গাড়িতে বা বাসে যাচ্ছেন। আবার কক্সবাজারের কথা ধরুন। আগে যেমন প্রচুর বিদেশি আসত, এখন সেই সংখ্যা কমে গেছে। বলতে পারেন যাত্রীর জোয়ার আর নেই। তবে সৈয়দপুরে যাত্রী বাড়ছে। কিন্তু কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে যা কমেছে, সেটা পূরণ করতে পারছে না। সব মিলিয়ে এয়ারলাইন ব্যবসা সেই অর্থে অত শক্ত অবস্থানে নেই।

প্র বাণিজ্য: আগেও তো ছিল না। যেমন আপনাদের আগে যাঁরা এই ব্যবসায় নেমেছিলেন, তাঁরা কেউই টিকে থাকতে পারেননি। কেন এটা হলো?

মফিজুর রহমান: আমাদের দেশে এয়ারলাইনস ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে শুরু হয় ’৯৭-৯৮ সালের দিকে। জিএমজির আগে কয়েকটি এয়ারলাইন এসেছিল। তারা টিকতে পারেনি। না টিকে থাকার কারণ, তখন প্রচুর বিধিনিষেধ ছিল। যেমন, বিমানের দুই ঘণ্টা আগে ফ্লাইট দেওয়া যাবে না, দুই ঘণ্টা পরেও না। আবার ৩০ সিটের বেশি এয়ারক্রাফট কেনা যাবে না—এসব। জিএমজি ভালোই করছিল, কিন্তু শেষের দিকে মনে হলো পরিকল্পনায় বড় ভুল ছিল। ছোট এয়ারলাইনের হঠাৎ করে বোয়িং ৭৪৭–এ যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। তারপর ওই সময় তেলের দাম বেড় গেল, সেই লোকসান জিএমজি আর কাটাতে পারল না।

প্র বাণিজ্য: নীতি ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি বেসরকারি এয়ারলাইন সরকারের কতটুকু আনুকূল্য পায়?

মফিজুর রহমান: সরকারি নীতির ক্ষেত্রে অনেক বাধা। প্রশাসন মনে করে, এটা বড়লোকের বাহন; যত পারো এখন থেকে ট্যাক্স আদায় করো। এটা মরে গেল না বেঁচে গেল, দেখার কেউ নেই। সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস বা সংশ্লিষ্ট সব অফিস বলেন, এই শিল্পকে পদে পদে বাধা অতিক্রম করে এগোতে হয়। যার কারণে যাঁরাই বাজারে আসেন, বাধার মুখে পড়ে বসে যান। আসলে বাংলাদেশে এয়ারলাইন ব্যবসায় যেমন বাধা তেমন খরচও বেশি। সে কারণে এই ব্যবসায় লাভ হয় না। এ ক্ষেত্রে এয়ারলাইনের দায়ও কম নেই।

প্র বাণিজ্য: শুধু অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী বহন করে কি এয়ারলাইনকে টিকে থাকা সম্ভব?

মফিজুর রহমান: এটা আপেক্ষিক ব্যাপার। নেপালের বুদ্ধ এয়ার ২০–২৫ বছর ধরে টিকে আছে। শুধু টিকে থাকেনি, তারা সম্প্রসারণ করেছে। কেননা আমাদের যে সেক্টরে ভাড়া ৩০ ডলার, একই ধরনের সেক্টরে নেপালে ভাড়া ১০০ ডলার। তফাত এখানেই। আসলে মার্কেট কি রকম, সেটাই বড় কথা। আমাদের দেশে ট্যাক্স অনেক বেশি, জ্বালানি খরচ বেশি। সেই তুলনায় আয় অনেক কম।

প্র বাণিজ্য: অভ্যন্তরীণ রুটে এত যাত্রী, বিমানের তুলনায় বেসরকারি এয়ারলাইনগুলো কতটা শেয়ার পাচ্ছে।

মফিজুর রহমান: দেখুন, অভ্যন্তরীণ রুটের ৮০ ভাগ যাত্রী বেসরকারি তিনটি এয়ারলাইন বহন করে। বিমান বহন করে ২০ ভাগ যাত্রী। ২০০৮ সালে সিদ্ধান্ত ছিল, বিমান অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজ চালাবে না। পরে সেই সিদ্ধান্ত বদল হয়।

প্র বাণিজ্য: অভ্যন্তরীণ রুটে যে টিকিট বিক্রি হয় তা তো কম নয়। টিকিটের দাম কি ঠিক আছে?

মফিজুর রহমান: আসল সমস্যা এখানেই। দেখুন, ১০ বছর আগে উড়োজাহাজের টিকিটের যে দাম ছিল, এখনো সেটাই আছে। বাড়েনি, বরং কমে গেছে। শুধু এই একটি সেক্টরই পাবেন, যেখানে ভাড়া কমেছে। দেখুন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান যে ভাড়া দিচ্ছে, তাকে সমন্বয় করতে গিয়ে কেউ আর ভাড়া বাড়াচ্ছে না। আবার আমরা নিজেরাও মার্কেট ধরতে ভাড়া বাড়াচ্ছি না। যে ভাড়া আছে, তাতে আমাদের খরচই ওঠে না। এই ব্যবসায় লাভ করতে হলে ভাড়া বাড়াতে হবে। ভাড়া কমানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে প্রতিবেশী দেশে কিংফিসার এবং জেট বসে গেল। খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে ভাড়া বাড়ালে হয়তো তাদের এই পরিণতি হতো না।

প্র বাণিজ্য: বিমানবন্দরগুলোতে আপনারা কেমন সুবিধা পান।

মফিজুর রহমান: উড়োজাহাজ পরিচালনায় সবচেয়ে দরকারি বিষয় হলো হ্যাঙ্গার। যেখানে উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এখানে হ্যাঙ্গার সুবিধাই নেই। বিমানের হ্যাঙ্গার ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া নিতে হয়। সেটাও সময়মতো পাওয়া যায় না। আবার টার্মিনালে যেসব সুবিধা দরকার, তার কিছুই সময়মতো মেলে না না। অভ্যন্তরীণ রুটে উড়োজাহাজকে বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হয়। এটা একেবারে অযৌক্তিক। একটি যন্ত্রাংশ আনতে হলে অনুমতির জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। অভ্যন্তরীণ রুটে অ্যারোনটিক্যাল চার্জও অনেক বেশি। এত চার্জ দিয়ে উড়োজাহাজ সংস্থার টিকে থাকা সম্ভব নয়। এটা কমাতে হবে। দেশি এয়ারলাইনের জন্য সরকারকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। যেখানে সব ধরনের শিল্পকেই সরকার সুবিধা দিয়ে থাকে, কেন সেটা এয়ারলাইন পাবে না।

প্র বাণিজ্য: জ্বালানি, ট্যাক্স, কাস্টমস সুবিধা নিয়ে আপনারা সরকারের কোনো পর্যায়ে কথা বলেননি?

মফিজুর রহমান: এটা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। কিন্তু কাজ হয় না। এটা যে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর, সেটাই মনে করা হয় না। যে কারণে সবাই ধরে নেয় সব দায় লগ্নিকারীর, আর কারও কোনো দায় নেই। এভাবে তো শিল্প টিকে থাকতে পারে না। 

মফিজুর রহমান
সাধারণ সম্পাদক, এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবি)