আকাশপথে ভরসা বেসরকারি এয়ারলাইনস

>উড়োজাহাজে চড়ে গন্তব্যে যাওয়া ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। ভাড়াও কমেছে, এমনকি তারা যাচ্ছেও সময়মতো। আর কম সময়ের মধ্যে চলে যাওয়া তো আছেই। বেসরকারি এয়ারলাইনসের এই অগ্রযাত্রা নিয়েই এবারের আয়োজন।

রুপালি একটা ছোট্ট চিল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে নীল আকাশে। সেখান থেকে একটানা গোঁ-গোঁ শব্দ ক্ষীণ থেকে প্রকট, তারপর ক্ষীণতর হয়ে অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। মেঘ ফুঁড়ে উড়োজাহাজ চলাচলের সেই দৃশ্য মাটিতে পা রেখে ওপরের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে দেখেননি এমন লোক মনে হয় কমই আছেন। 

তবে হালে বেড়ে ওঠা কিশোর-তরুণদের কাছে এ গল্প অবশ্য সেকেলে। আজকাল উড়োজাহাজের এমন ওড়াউড়ি তাদের কাছে চোখসওয়া। তেমনি উড়োজাহাজে চড়ার খরচও নাগালের মধ্যে। আমজনতার চলাচলের অন্য সব পথের মতোই এখন যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে আকাশপথ। তাই ভূপেন হাজারিকার ‘লন্ডন যাব হাওয়াই গাড়িতে’ গানটি শুনে কেউ আর অতটা পুলকিত হন না। 

আকাশপথে মানুষের এই চলাচল সহজ থেকে সহজতর করে দিয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইনস। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস অনেক আগে থেকে এ কাজ করে এলেও তার আসন ও গন্তব্য ছিল হাতে গোনা। বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা সেগুলো সহজ করে দিয়েছে। তাদের গণ্ডিও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। এখন আটটি বিদেশি ও সাতটি দেশি গন্তব্যে হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে উড়ে যাচ্ছে বেসরকারি উড়োজাহাজ। আর টিকিট? তা–ও হাতের মুঠোয়। মুঠোফোনের একটি বাটন ছোঁয়াতেই উড়োজাহাজের টিকিট মিলছে। 

উড়োজাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিভিল এভিয়েশনের হিসাবে ২০১৮ সালে দেশের সব কটি বিমানবন্দর থেকে প্রায় এক কোটি যাত্রী দেশে-বিদেশে যাতায়াত করেছেন। এর মধ্যে বিদেশে যাতায়াত করা যাত্রী ছিলেন ৮২ লাখ ৬৫ হাজার। আর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিলেন ১৮ লাখ ২১ হাজার। এই হিসাব থেকে পরিষ্কার যে যত লোকে বিদেশে যাতায়াত করছেন তার চার ভাগের এক ভাগে যাত্রী অভ্যন্তরীণ রুটে যাতায়াত করেছে। প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। 

বেসরকারি উড়োজাহাজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১২-১৩ সালে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী ছিলেন সাড়ে ৬ লাখ, ২০১৫ সালে তা হয় সোয়া ৯ লাখ। ২০১৭ সালে যাত্রী বেড়ে হয় সাড়ে ১২ লাখ। আর ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ১৮ লাখ ২১ হাজার। এই হিসাবে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ রুটে ৬ বছরে যাত্রী বেড়েছে তিন গুণের বেশি। যার ৮০ শতাংশ যাত্রীই বহন করেছে বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা। আন্তর্জাতিক রুটেও বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো ভাল করছে। 

উড়োজাহাজ পরিচালনা সংস্থাগুলোর হিসাবে দেশি-বিদেশি মিলে উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহনের বাজার প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের। এই বাজারের ২০-২২ শতাংশ মাত্র দেশি উড়োজাহাজ সংস্থার দখলে, বাকি ৭৭-৭৮ শতাংশই বিদেশি উড়োজাহাজের প্রতিষ্ঠানের হাতে। 

অভ্যন্তরীণ রুটে যে চারটি সংস্থা উড়োজাহাজ পরিচালনা করছে তার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইনস। বেসরকারি তিনটি সংস্থা হলো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন, নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। ২০১৮ সালে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ৪৬ হাজার ৯৮৮টি ফ্লাইট যাতায়াত করেছে। যার বেশির ভাগই বেসরকারি সংস্থার উড়োজাহাজ পরিচালনা করেছে। 

যেভাবে যাত্রা শুরু

বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইনস যাত্রা শুরু করে ১৯৯৫ সালের দিকে। মোট ১১টি প্রাইভেট এয়ারলাইনস বিভিন্ন সময় লাইসেন্স পেলেও এখন টিকে আছে মাত্র তিনটি। 

১৯৯৫ সালে প্রথম বেসরকারি এয়ারলাইনস হিসেবে লাইসেন্স পায় অ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইন। ১৯৯৭ সালে তারা যাত্রী পরিবহন শুরু করে। তবে এক বছরও সেটি টিকে থাকেনি। একে একে বন্ধ হয়ে যায় জিএমজি এয়ারলাইনস, এয়ার পারাবাত, এয়ার বাংলাদেশ, জুম এয়ারওয়েজ, বেস্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার ও রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইনস। এই এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে শুধু জিএমজি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করেছে৷ তবে এর কোনোটি এখন আর চালু নেই। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ যাত্রা শুরু করে ১১টি উড়োজাহাজ নিয়ে। লিজে আনা ১১টি উড়োজাহাজের সব কটি অকার্যকর হয়ে যায়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করেও টিকে থাকতে পারেনি ইউনাইটেড। 

বেসরকারি এয়ারলাইনস বলতে এখন ইউএস–বাংলা, নভোএয়ার এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজ টিকে আছে। নেপালে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেসরকারি এয়ারলাইনসের সক্ষমতা এবং যাত্রীসেবা নিয়ে সাময়িক কিছু আলোচনা হয়েছিল৷ কিন্তু তার নেতিবাচক কোনো প্রভাব এই ব্যবসায় পড়েনি। ইউএস-বাংলার এখন সাতটি অভ্যন্তরীণ এবং আটটি আন্তর্জাতিক রুটে, নভোএয়ার সাতটি অভ্যন্তরীণ এবং একটি আন্তর্জাতিক রুটে৷ রিজেন্ট এয়ার দুটি অভ্যন্তরীণ এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

অভিজ্ঞ পাইলট ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের নির্বাহী পরামর্শক শিকদার মেজবাহউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর যাত্রীসেবা অনেক ভালো। কারণ, আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তাদের যাত্রী পেতে হয়। যাত্রীসেবার প্রথম শর্ত হলো শিডিউলমতো ফ্লাইট অপারেশন। দেশি এয়ারলাইনসগুলোর অনবোর্ড সার্ভিসও বেশ মানসম্পন্ন। সে কারণেই দিন দিন যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে ফ্লাইটের সংখ্যাও বাড়ছে। আগে যেখানে দিনে একটি ফ্লাইটও চলত না, এখন সেখানে দিনে ১০-১২টি ফ্লাইট চলছে। 

তারপরও কেন বন্ধ হচ্ছে

এত যাত্রী থাকার পরও কেন বাংলাদেশে বেসরকারি এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? কেন ব্যবসা করতে পারছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে একেকজন একেক কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, ১০ বছরে উড়োজাহাজের ভাড়া বাড়েনি, বরং কমেছে। ২০১২ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ভাড়া ছিল সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা। এখন সেই ভাড়া ২ হাজার ৭০০ টাকা। সব রুটে একই অবস্থা। যাত্রী ধরতে সবাই ভাড়া কমিয়ে দেয়, এখন যাত্রী হারানোর ভয়ে সেই ভাড়া কেউ বাড়াতে পারছে না। অথচ এত কম ভাড়ায় কোনো উড়োজাহাজ সংস্থার চলা সম্ভব নয়। 

 আবার কেউ কেউ বলেছেন, একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনস চালানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোক্তা দরকার, যেমন দক্ষতা-ব্যবস্থাপনা দরকার সেগুলো এখনো গড়ে ওঠেনি৷ ফলে কেউই টিকে থাকতে পারছে না৷ তাঁরা মনে করছেন, দুটি কারণে এয়ারলাইনসগুলো বন্ধ হয়েছে। একটি অব্যাহত লোকসান, অন্যটি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি।

ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের ট্যাক্স, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মিটিয়ে বিমান সংস্থাগুলোর লাভ করে চলা একেবারেই অসম্ভব। পৃথিবীর সব দেশই নিজ দেশীয় বিমান সংস্থাগুলোর চার্জ কম নিয়ে থাকে, আমাদের উল্টো। এখানে চার্জ এত বেশি যে সব দিয়ে কোনো দিন লাভের মুখ দেখা যাবে না।’ 

রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে গেলে নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এ রক্ষণাবেক্ষণের একটি পর্যায় হলো সি-চেক। এই সি-চেক নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমানের ছাড়া আর কারও হ্যাঙ্গার নেই। সেই হ্যাঙ্গারের জন্য লাইনে থাকতে হয়। সময়মতো সেটা পাওয়া যায় না। অথচ এয়ারক্রাফটকে বসে রাখা যায় না। বসে থাকলেই লোকসান গুনতে হয়। 

কী করতে হবে

বেসরকারি উড়োজাহাজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, উড়োজাহাজ পরিবহন খাত নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা নেই। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ট্যাক্স আদায় করেই ক্ষান্ত। অথচ লাল লাখ মানুষ এই সেক্টর ব্যবহার করছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজি এর সঙ্গে যুক্ত। 

তাঁরা বলছেন, এই সেক্টরের কোনো নীতিমালা নেই। গত ২২-২৩ বছরে সরকার বলতে গেলে এর জন্য কিছুই করেনি। যা হয়েছে তা উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো নিজেরাই করেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো জ্বালানি তেলের যে দাম দেয়, তা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আবার অনেক দেশে অভ্যন্তরীণ রুটের ছোট উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং-পার্কিং ফ্রি করা থাকে। এটাও ফ্রি করে দেওয়া হোক। 

নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, উড়োজাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। উড়োজাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ জ্বালানিতে। অভ্যন্তরীণ রুটের ক্ষেত্রে সেই জ্বালানি আন্তর্জাতিক রুটের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। জ্বালানির পাশাপাশি ট্যাক্সও কমাতে হবে। তা না হলে শুধু এয়ারলাইন ব্যবসা করে কেউ টিকে থাকতে পারবে না।