এবার শেয়ার বেচে টাকা তুলবে সরকার

এবার শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলবে সরকার। এ জন্য সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সরাসরি তালিকাভুক্তি বা ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে চাইছে সরকার। এর ফলে অবশ্য বাজারে ভালো শেয়ারের সংখ্যাও বাড়বে।

সরকারি পাঁচ ব্যাংককে শেয়ারবাজারে আনতে গতকাল রোববার অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক সভা করেছেন। সেখানে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে, যাতে অক্টোবরের মধ্যে বাজারে শেয়ার ছাড়া সম্ভব হয়। যে পাঁচ ব্যাংককে নিয়ে এ সভা হয় সেগুলো হলো রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল), অগ্রণী, জনতা ও সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক তালিকাভুক্ত হওয়ায় ব্যাংকটির আরও কিছু শেয়ার সবার আগে ছাড়া হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাজারে আনা হবে বিডিবিএল, অগ্রণী, জনতা ও সোনালী ব্যাংককে। ধাপে ধাপে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

নিয়ম অনুযায়ী, সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে কোনো শেয়ার বিক্রি করা হলে ওই শেয়ার বিক্রি বাবদ পাওয়া অর্থ জমা হয় শেয়ারের মালিকের হিসাবে। আর প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও এবং বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে কোনো কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছাড়লে ওই শেয়ার বিক্রির অর্থ জমা হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির তহবিলে। আইপিও এবং বুকবিল্ডিং পদ্ধতির বাইরে সরকার সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে নিজের শেয়ারের মালিকানা বিক্রি করে বাজার থেকে অর্থ তুলতে চায়।

এদিকে, সরকারের টাকা তোলার এ উদ্যোগের পরও শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গতকাল দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল এক দিনেই ৬৪ পয়েন্ট বা প্রায় দেড় শতাংশ কমেছে। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি কমেছে ১৩১ পয়েন্ট বা প্রায় ১ শতাংশ।

>

সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ৫ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আলোচনায় আরও ৭ কোম্পানি।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। কিন্তু আস্থা ও তারল্যসংকট দূর করার তাৎক্ষণিক কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় বাজারে আবারও পতন দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত হলে তাতে বাজারের ভালো শেয়ারের ঘাটতি কিছুটা হলেও দূর হবে। এতে উভয় দিক থেকে সরকার লাভবান হবে। একদিকে শেয়ার বিক্রি করে সরকার টাকা পাবে, অন্যদিকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করবে। মির্জ্জা আজিজ মনে করেন, বাজারে আনার আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালোভাবে নিরীক্ষা করানো দরকার, যাতে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি না থাকে। ব্যাংকের শেয়ার বাজারে আনার আগে ব্যাংক খাতের বর্তমান দুরবস্থা দূর করতে হবে, তা না হলে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গত ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা শেষে বিএসইসির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাজারের উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে প্রথমে ছিল ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার বিষয়টি পর্যালোচনা করা, আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাজারে আস্থা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ এবং বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ওই বৈঠকের পর সরকারি ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে ৪ হাজার পয়েন্টে নেমে আসা ডিএসইর প্রধান সূচকটি বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টের ওপরে ওঠে। লেনদেনও ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু গতকালের বড় দরপতনের পর ডিএসইএক্স সূচকটি ৪ হাজার ৩৮৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

বৈঠকে যা হলো

গতকালের বৈঠকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ার ছাড়ার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার বাজারে রয়েছে। নতুন করে এটির আরও ১০ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়তে চায় সরকার। এর বাইরে ধাপে ধাপে বাকি চারটি ব্যাংকেরও ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কর্মকর্তারা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি এবং আইসিবির এমডি উপস্থিত ছিলেন।

বর্তমানে শেয়ারবাজারে রূপালী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার ২৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। বাজারমূল্যের ভিত্তিতে যদি বাড়তি আরও ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া হয়, তাতে সরকার পাবে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। বাকি চারটি ব্যাংকের শেয়ার যেহেতু সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই ওই চার ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে সরকার কত টাকা তুলতে পারবে, তা নির্ভর করছে বাজারে কত দামে এসব শেয়ার বিক্রি হবে, তার ওপর।

ব্যাংকের বাইরে সরকারি আরও সাত কোম্পানির শেয়ার ছাড়ারও ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। কোম্পানিগুলো হলো তিতাস গ্যাস, পাওয়ার গ্রিড, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি, বি-আর পাওয়ারজেন ও গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি।

গতকালের বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিডিবিএল ও অগ্রণী ব্যাংককে শেয়ারবাজারে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরপর পর্যায়ক্রমে জনতা ও সোনালী ব্যাংককে বাজারে আনা হবে। আর রূপালী ব্যাংকের আরও কিছু শেয়ার ছাড়া হবে এ সময়ের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে বাজারে আনতে একটি কমিটি করে দিয়েছি। কমিটিতে চারটি ব্যাংকের একজন করে থাকবেন। আইসিবি সেটির সমন্বয় করবে।’

২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের আগেও সরকারি বিভিন্ন কোম্পানিকে বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় একাধিক দফায় সময়সীমা বেঁধে দিয়েও সরকারি কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনা সম্ভব হয়নি। তবে ওই ধসের আগে জনতা ব্যাংক শেয়ারবাজারে আসতে প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চ প্রিমিয়াম দাবির কারণে শেষ পর্যন্ত ওই প্রস্তাব আর আলোর মুখ দেখেনি।

গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকে কী উপায়ে বাজারে আনা যায়, তা নিয়েই মূলত এ সভার আয়োজন করা হয়। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যে ধরনের নীতি ছাড় প্রয়োজন, বিএসইসি তা প্রদান করবে। প্রথম দিকে ৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়া হতে পারে, ধীরে ধীরে তা ২৫ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই ব্যাংককে শেয়ারবাজারে আনতে হবে। এ জন্য সম্পদ মূল্যায়নসহ সব প্রক্রিয়া শুরু করব।’

আর শেয়ারবাজারে এ উদ্যোগের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজারের ওপর কী প্রভাব পড়বে, আমি বলতে পারব না। পুঁজিবাজের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজারে আনা হচ্ছে।

এদিকে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের হাতে থাকা ইউনিলিভারের মতো বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারও বাজারে আনা দরকার। তাতে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ আসবে।