যখন ব্যবসায়ীদের পথে পথে শুল্ক দিতে হতো

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই বিখ্যাত কাশিমবাজার কুঠি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই বিখ্যাত কাশিমবাজার কুঠি

বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করলে শুল্ক দিতে হয়। অনেক সময় বিদেশে কিছু পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সেগুলোর ওপরও শুল্ক বসে। কিন্তু দেশের ভেতরে কোনো বাজারে বিক্রির জন্য পণ্য নিয়ে গেলেও শুল্ক দিতে হবে—এমন কথা এখন তো ভাবাই যায় না। ভাবনার বাইরের এ কথাও একসময় সত্য ছিল। ১৮৩৬ সালের আগে ঢাকাসহ পুরো বাংলায় উৎপাদকেরা বাজারে পণ্য নিয়ে যাওয়ার সময় পথে পথে শুল্ক আরোপ করা হতো। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের শুল্কের নাম ছিল ‘সায়ের’। 

মুঘল রাজস্বব্যবস্থায় ‘সায়ের’ ছিল শুল্ক, যা হাটবাজার, গঞ্জ, নদীঘাট, নৌ-সড়কপথে বিভিন্ন স্থানে চৌকি বসিয়ে আদায় করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে অবশ্য এই শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তবে আকবরের মৃত্যুর পর আবার শুল্ক আদায় শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ১৭১৭ সালে বার্ষিক তিন হাজার সিক্কা টাকার বিনিময়ে এ ধরনের শুল্ক আদায় থেকে অব্যাহতি নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় জমিদারেরাও নিজ নিজ এলাকায় নানা নামে ‘সায়ের’ আদায় করত। বিশেষ করে এ ধরনের সায়ের শুল্কের ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছিল, যখন মোগলদের কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। স্থানীয় জমিদার, তালুকদারেরা ব্যবসায়ীদের কাছ সায়ের আদায় করে। ব্যবসায়ীদের নিজেদের পণ্যের চালান নিয়ে কাছে কিংবা দূরের বাজারে নেওয়াকে ‘রওয়ানা’ বলা হতো। এই রওয়ানায় পথে পথে বসানো চৌকিতে ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হতো। এমনকি ফেরিওয়ালা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও এই শুল্কের হাত থেকে রেহাই পেতেন না। ফলে এ দেশের মাঠঘাটের ছোট ছোট ব্যবসায়ী শুল্কের ভারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। 

ফলে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন বড় ব্যবসায়ীরা। ফলে সাধারণ ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার কৃষিতে মনোনিবেশ করতে থাকে। 

শুল্ক আদায়ের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রাজস্বব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে ১৮১০ সালে ইংরেজরা নবম রেজল্যুশন দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও নগদ শুল্ক পুনর্বিন্যাস করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার চৌকি তুলে দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে ছয়টি কাস্টম হাউস গঠন করা হয়। কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও বালাশোরে এই কাস্টম হাউসগুলো হয়। এসব কাস্টম হাউসে কালেক্টর অব কাস্টমস নিয়োগ দেওয়া হয় ইউরোপীয়দের। ভাবা হয়েছিল, এতে যত্রতত্র শুল্ক আদায় বন্ধ হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। কিন্তু এসব কাস্টম হাউস শুল্ক আদায়ে আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কাস্টম হাউসের দেশীয় এজেন্টরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠেন। 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিস্টরি অব ইন্টারনাল ট্রেড ব্যারিয়ার বইয়ে বলা হয়েছে, ওই সময় বোর্ড অব কাস্টমসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৮৩১-৩২ সালে সারা বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে শুল্ক সংগ্রহ করা হয়েছিল ৬ লাখ ৮১ হাজার ১২৬ রুপি। এই শুল্ক আদায় করতে খরচ হয়েছিল ৪ লাখ ৬ হাজার ৯৮৬ রুপি। এতে নিট আয় দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ১৪০ রুপি। এ ছাড়া এই ত্রুটিপূর্ণ শুল্ক আদায়ের বিপক্ষে মত দেয় বোর্ড অব কাস্টমস। নানামুখী পর্যালোচনার পর ১৮৩৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অভ্যন্তরীণ শুল্ক আদায় পদ্ধতি বাতিল করে। ফলে এ দেশের ব্যবসায়ীরা প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের মতো স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ পান। 

সূত্র: ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস