পকেটের টাকা জমা থাকে বিকাশে

একবার এক বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়ে পড়লেন বিব্রতকর অবস্থায়। খাওয়া শেষে বয়-বেয়ারা বকশিশ চাইলেন। কিন্তু পকেটে টাকা নেই। বকশিশ দেবেন কীভাবে? লজ্জায় যখন নিজের মধ্যে, তখনই মাথায় এল ‘বিকাশ’–এর কথা। বয়-বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলেন—বিকাশ আছে? জবাব মিলল, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে বকশিশ দিয়ে দিলেন। কথাগুলো কামাল কাদীরের। সামাজিক অনুষ্ঠানে বিব্রতকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে যে মাধ্যমটি, বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তিনি।

কামাল কাদীর বলেন, এখন প্রায়ই পকেটে টাকা থাকে না। পকেটে টাকা রাখার অভ্যাসটাই বদলে গেছে। এ জন্য অবশ্য মাঝেমধ্যে ঝক্কিঝামেলায়ও পড়তে হয়। আর তখন ভরসা হয়ে ওঠে হাতের মুঠোফোনটি। যেখানে নগদ টাকার বিকল্প হয়ে আছে বিকাশ নামের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস সেবাটি।

২০০৮ সাল থেকে যখন এমএফএস চালুর বিষয়টি কামাল কাদীরের মাথায় এসেছিল, তখন মনে মনে মূলত তিনি এমন একটি সেবার কথাই ভাবছিলেন। যে সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অল্পস্বল্প অর্থের দ্রুত ও নিরাপদ লেনদেন সম্পন্ন হবে। তাই যখন দাওয়াতে গিয়ে বকশিশের টাকা কিংবা গভীর রাতে কোনো রিকশাচালকের ভাড়া বিকাশে পরিশোধ করতে পারেন, তখন পুলকিতই হন তিনি। বুঝতে পারেন তাঁর স্বপ্নটি পুরোপুরি বিকশিত না হলেও সঠিক পথেই রয়েছে।

২০০৫ সালে দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে গড়ে তোলেন সেলবাজার নামে অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার একটি প্ল্যাটফর্ম। সেটি করতে গিয়েই টের পেলেন ইন্টারনেটের যুগে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে প্লাস্টিক কার্ড বা বিকল্প ব্যবস্থার ঘাটতির বিষয়টি। তখনই চিন্তা আসে এ সমস্যার সমাধান করা দরকার। সেই চিন্তার হাত ধরে ২০১০ সালে জন্ম নেয় ‘বিকাশ’।

সম্প্রতি এক বিকেলে রাজধানীর স্বাধীনতা টাওয়ারে নিজ কার্যালয়ে বসে বিকাশের জন্ম, পথচলা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে কথা হয় কামাল কাদীরের সঙ্গে। গল্পে-আড্ডায় তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে টাকার গায়ে একটি বাক্য দেখে আসছি, সেটি হলো—‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে।’ আমি যখন নগদ টাকার পরিবর্তে লেনদেনের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে একটা কিছু করার কথা ভাবছিলাম, তখন বারবার ওই বাক্যটিই মাথায় ঘুরপাক খেত।

কাগজের নোট যদি চাহিবামাত্র গ্রাহক পেতে পারেন, তাহলে অন্য কোনো মাধ্যমে সেটি হবে না কেন? সেটিই পরবর্তী সময়ে সম্ভব হয়েছে এমএফএসের মাধ্যমে।

কামাল কাদীর
কামাল কাদীর

বিকাশের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানি ইন মোশন ও ব্র্যাক ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে। মানি ইন মোশন ও ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়াও বর্তমানে এটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), বিশ্বসেরা ধনী বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের নামে প্রতিষ্ঠিত বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং চীনের বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আলিবাবা গ্রুপের সহযোগী অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল বা আলিপে।

বর্তমানে দেশের এমএফএস বাজারের সিংহভাগ বিকাশের সেবার আওতায় থাকলেও এ দেশে প্রথম এমএফএস প্রতিষ্ঠান ডাচ্​বাংলা ব্যাংকের রকেট। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১০ সালের এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পায় বিকাশ। ২০১১ সালে এটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বিকাশের গ্রাহক ৩ কোটি ৭০ লাখ। এসব গ্রাহক দিনে ৯০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেন। আর গ্রাহকের এ লেনদেনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে দেশজুড়ে বিকাশের রয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার এজেন্ট ও ২২০টি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান। ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান ও ১৭টি ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিকাশ।

২০১১ সালে যখন যাত্রা শুরু হয় তখন এ সেবার মাধ্যমে টাকা পাঠানো, টাকা উত্তোলনের মতো সেবা পাওয়া যেত। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, এ সেবার পরিধিও তত বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন পরিষেবা বিল পরিশোধ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন–ভাতা প্রদান, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন কেনাকাটা ও রাইড শেয়ারিং সেবার বিল পরিশোধ, বাস, ট্রেন ও লঞ্চের টিকিট কেনা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি মাশুল প্রদান, দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার অনুদান ও ঋণ বিতরণ, ঋণের কিস্তি সংগ্রহ, ভিসা ক্রেডিট কার্ডের বিল শোধ, ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা মিলছে। দিন দিন এ সেবার পরিধি শুধু বেড়েই চলেছে।

আলাপকালে কামাল কাদীর বলেন, বিকাশসহ বাংলাদেশে এমএফএসের ভবিষ্যতে খুবই উজ্জ্বল। অনেক দূর যাওয়ার আছে এখনো এ সেবার। ব্যাংকিং সেবাকে আরও বেশি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব, এ ধরনের সেবাকে ব্যবহার করে। যদিও আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো এখনো বিকাশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে সেবা ছড়িয়ে দেওয়া কাজটিতে খুব বেশি এগিয়ে আসেনি। মাত্র কয়েকটি ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। সব ব্যাংক যখন এ সেবাকে ব্যবহার করতে শুরু করবে, তখন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের সঞ্চয়ের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে আসবে। আবার ব্যাংকগুলো চাইলে ছোট ছোট ঋণ বিতরণও বাড়াতে পারবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষের প্রতিদিনের আর্থিক লেনদেনের সবকিছু মুঠোফোনে করা সম্ভব হবে।

তবে বিকাশের যাত্রার শুরুটা একেবারে মসৃণ ছিল, তা–ও নয়। নানা প্রতিবন্ধকতা উতরে পথ চলতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কামাল কাদীর মনে করেন, সমস্যার মধ্যেই সমাধানের সূত্র লুকিয়ে থাকে। তিনি বলেন, ‘সমস্যা থেকেই আমরা সমাধানের পথ খুঁজে বের করি। আর যেহেতু এ সেবাটি প্রযুক্তিনির্ভর, তাই সমস্যা থাকবেই। এ কারণে প্রযুক্তিকে সব সময় আপডেট রাখতে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি।’

২০১০ সালে বিকাশের জন্মের সময়ই ঠিক করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হবে ‘মুনাফার জন্য ব্যবসা’। যাত্রা শুরুর ছয়–সাত বছরের মধ্যে এটি লাভের মুখ দেখবে বলেও প্রাথমিক পরিকল্পনার সময় ভাবা হয়েছিল। সেই ভাবনার খুব বেশি হেরফের হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে টানা ৪ বছর মুনাফা করেছে বিকাশ। তবে সেই মুনাফা থেকে কোনো লভ্যাংশ নেননি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। বরং বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। তবে ২০১৯ সালে বড় ধরনের বিনিয়োগের কারণে ধারাবাহিক মুনাফায় কিছুটা ছেদ পড়ে।

বিকাশের সেবা মাশুল বেশি—এ অভিযোগ গ্রাহকের। আবার বিকাশকে অপব্যবহার করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সেবার বিনিময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে যে অর্থ নিই, তার বড় অংশই এজেন্ট, ডিলার, নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়। এটি এমন একটি সেবা, এজেন্ট ও ডিলারদের পর্যাপ্ত ইনসেনটিভ দেওয়া না হলে তাঁরা এ সেবা দিতে আগ্রহী হবেন না। তারপরও বিকাশ প্রতিনিয়ত সেবা মাশুল কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

হুন্ডি প্রসঙ্গে কামাল কাদীর বলেন, ‘বিদেশে বিকাশের নাম ব্যবহার করে যারা এ ধরনের কাজ করছে, তার সঙ্গে বিকাশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং আমাদের উদ্যোগে বিদেশে এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে মিলে আমরা বৈধ পথে প্রবাসী আয় দেশে আনার কাজটি যাতে আরও সহজে করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছি। তাতে কিছুটা সফলতাও পেয়েছি।’

বিকাশের এ পথচলার বিশ্ব স্বীকৃতিও মিলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। তারই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে বিশ্বখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনের ‘চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড লিস্ট’-এ বিশ্বসেরা ৫০টি কোম্পানিতে জায়গা করে নেয় বিকাশ।