ডাচ্-বাংলার টাকার রকেট

বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার পথিকৃৎ বলা হয় ডাচ্​বাংলা ব্যাংককে। যখন অনেক ব্যাংক এটিএম সেবা চালু করেনি, ঠিক তখনই সারা দেশে এটিএম সেবা ছড়িয়ে দিয়েছে ডাচ্​বাংলা ব্যাংক। শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছে বিনা মাশুলের এটিএম কার্ড। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের মার্চে ডাচ্‌​–বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। ২০১৬ সালে এ সেবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রকেট, যা এখন টাকার রকেট নামে পরিচিত।

দেশে ডাচ্‌​–বাংলাই প্রথম ব্যাংক, যাদের হাত ধরে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস সেবা চালু করে। বর্তমানে দেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ২২ শতাংশ রকেটের। রকেট শুধু টাকা জমা ও উত্তোলনের মধ্যে আটকে নেই। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বিক্রির টাকা সংগ্রহ হয় রকেটের মাধ্যমে, আবার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতাও দেওয়া হয়। সরকারি ভাতা, বৃত্তির টাকা, পরিষেবা বিল পরিশোধ সুবিধা তো রয়েছেই।

রকেট সেবা চালুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ডাচ্​বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাচ্‌​–বাংলা ব্যাংক শুরু থেকেই প্রযুক্তিতে এগিয়ে। ২০০৪ সালে আমরাই প্রথম এটিএম সেবা চালু করি। তবে এটিএম সেবার মাধ্যমে সব শ্রেণির কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাই গ্রামের তথা প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে আমরা বিকল্প কিছু খুঁজছিলাম। তারই অংশ হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করা হয়।’ এ সেবার নাম পরিবর্তন বিষয়ে ডাচ্‌​–বাংলার এমডি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নিজস্ব ব্র্যান্ড বা পরিচয় দাঁড় করাতেই ২০১৬ সালে নাম পরিবর্তন করা হয়।

এটিএম ও শাখা ব্যাংকিং দিয়ে সারা দেশের সব মানুষের কাছের ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়, এটা বুঝতে পেরে ২০০৯ সালে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর কাজ শুরু করে ব্যাংকটি। ওই সময় কেনিয়া, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও ফিলিপাইনে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেশেও এ সেবা চালুর উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই সময় মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নীতিমালাও জারি করে। নীতিমালায় বলা হয়, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা হবে ব্যাংক নেতৃত্বাধীন। এমনকি গ্রাহকদের যত টাকা এ সেবায় জমা হবে, দিন শেষে তার পুরোটাই ব্যাংক হিসাবে জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এ নীতিমালার আওতায় ২০১১ সালে প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে ডাচ্​বাংলা।

ডাচ্‌​–বাংলার এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘গ্রাহকদের অর্থের যেন পুরো নিরাপত্তা থাকে, আমরা শুরু থেকেই সেই ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট ছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতিমালা সেভাবে করেছে। এতে দিন শেষে পুরো টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা থাকছে। তাই গ্রাহকের অর্থ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না।’

ডাচ্‌​–বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় শুরুর দিকে শুধু টাকা জমা, উত্তোলন ও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি টাকা পাঠানোর সুযোগ ছিল। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিষেবা বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, করপোরেটদের টাকা সংগ্রহ, বেতন প্রদান, ভাতা প্রদান, বৃত্তি প্রদানসহ আরও অনেক ধরনের সেবা যুক্ত করা হয়।

এখন সারা দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির টাকা সংগ্রহ করা হয় রকেট হিসাবের মাধ্যমে। খুচরা ক্রেতারা নির্দিষ্ট রকেট হিসাবে টাকা জমা দেয়, এ জন্য প্রতি হাজারে ২০ থেকে ২২ পয়সা মাশুল গুনতে হয়। আর নির্দিষ্ট সময় শেষে ওই টাকা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা করে দেয় ডাচ্​বাংলা ব্যাংক। এভাবে বার্জার পেইন্ট, এশিয়ান পেইন্ট, ট্রান্সকম বেভারেজেস, বাটা শু, পারফেটি ভেনমেলি বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বিআরবি কেব্​লস, রানার অটোমোবাইল, প্রাইম লাইফ ইনস্যুরেন্স, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্সসহ ১৩০টি প্রতিষ্ঠানের অর্থ সংগ্রহ হয় রকেটের মাধ্যমে। গত ডিসেম্বরে রকেটের মাধ্যমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ১৯৬ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছিল।

আবুল কাশেম মো. শিরিন
আবুল কাশেম মো. শিরিন

বর্তমানে দেশের ৬১১টি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয় রকেট হিসাবের মাধ্যমে। এর বেশির ভাগই পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান। রকেটের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়া শীর্ষ গ্রুপগুলো হলো নোমান, ফকির, অ্যাপেক্স, মোহাম্মদী, এসিআই, প্রাণ-আরএফএল, রানার, ডিবিএল, বেঙ্গল ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপি। প্রতি মাসে ৭৮৪ কোটি টাকা বেতন-ভাতা বিতরণ হয় রকেটের মাধ্যমে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে পরিশোধ হওয়া বেতন-ভাতার ৭০ শতাংশই রকেটের মাধ্যমে হয়।

এ ছাড়া ব্রিজের টোল সংগ্রহও করা হয় রকেট হিসাবের মাধ্যমে। এর ফলে ব্রিজ পার হওয়ার সময় ডাচ্‌​–বাংলার রকেট হিসাব থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল সংগ্রহ হয়ে যায়। বর্তমানে মেঘনা, গোমতী ও ভৈরব সেতুতে রকেটের মাধ্যমে টোল সংগ্রহ করা হয়।

জানা গেছে, বর্তমানে রকেটের সক্রিয় গ্রাহক ১ কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক ১ কোটি ২১ লাখ ও নারী গ্রাহক ৬১ লাখ। এসব হিসাবে গড়ে জমা থাকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। আর সারা দেশে রকেটের এজেন্ট রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার, যেখান থেকে গ্রাহকেরা টাকা জমা ও উত্তোলন করতে পারে। সারা দেশের ২৭৭ জন পরিবেশকের মাধ্যমে এজেন্টগুলো পরিচালিত হয়।

গত ডিসেম্বরে রকেটের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে, উত্তোলিত হয়েছে ৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, যা পুরো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ২৫ শতাংশ। এক মাসে গড়ে পরিষেবা বিল পরিশোধ হয় ১৪০ কোটি টাকা।

রকেটের এত সব অর্জনের পরও এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন মনে কষ্ট আছে। তিন বলেন, ‘মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং সেবাকে টাকা পাঠানোর মাধ্যমে হিসেবে নিয়েছে। এটা টাকা জমানোর মাধ্যম না হয়ে ডাকঘর বা কুরিয়ার সার্ভিসের বিকল্প হয়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষের টাকা বালিশের ভেতর থেকে বের হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসলে ভালো হতো। এ সুযোগ ছিল, আমরা হারিয়েছি। এখনো গ্রামে অনেক অলস টাকা পড়ে আছে।’

রকেটের টাকা পাঠানো ও উত্তোলনে মাশুল অন্য সব মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মতো। তবে রকেটে রয়েছে বাড়তি কিছু সুবিধা। রকেটের টাকা তোলা যায় ডাচ্‌​–বাংলা ব্যাংকের ১৯৫টি শাখা ও ৪ হাজার ৭৬৩টি এটিএম থেকেও। এতে খরচ প্রতি হাজারে মাত্র ৯ টাকা। আবার অ্যাপের মাধ্যমে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে টাকাও পাঠানো যায় বিনা মূল্যে।