'নয়-ছয়'-এর প্রথম ধাক্কায় সুদ কমল ডাকঘর সঞ্চয়ের

ডাকঘর সঞ্চয় স্কিম বা কর্মসূচির সুদের হার কমিয়ে অর্ধেক করেছে সরকার। বলা যায় এটি হচ্ছে ‘নয়-ছয়’-এর প্রথম ধাক্কা। মূলত সাধারণ মানুষই ডাকঘরের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে। আর এই সঞ্চয় কর্মসূচি শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি জনপ্রিয়। মূলত স্বল্প আয়ের মানুষেরাই ডাকঘরে টাকা রাখতে যায় বেশি। এই মানুষগুলোর যাওয়ার জায়গা সীমিত হয়ে গেল।

দেশে এখন ৫৯টি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনেক ব্যাংক হলেও দেশের বড় অংশ এখনো ব্যাংকিংয়ের আওতার বাইরে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এই সংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংক একপ্রকার জোর করেই বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকে পল্লি অঞ্চলে শাখা খুলতে বাধ্য করেছে। তারপরও ব্যাংকে আদৌ যায় না এমন মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। আর এসব মানুষের কাছে ডাকঘর জনপ্রিয়। এখানে ব্যাংকের মতোই বিভিন্ন মেয়াদে টাকা রাখা যায়। মেয়াদ শেষে পাওয়া যায় সুদ।

এমনিতে বাংলাদেশে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। প্রথমত, ব্যাংকে আমানত রাখা যায়। তবে ব্যাংক আমানতের সুদের হার সাধারণত কমই থাকে। আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে নানা ধরনের জাতীয় সঞ্চয়পত্র। সাধারণ মানুষ, অবসর নিয়েছেন যাঁরা, গৃহিণী, কিছুটা অসহায়—এসব মানুষের জন্য দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে এই স্কিম। কারণ, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কিছুটা বেশি এবং নিরাপদ। যাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না, তাঁরাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন বেশি। আর যাঁরা ঝুঁকি নিতে জানেন, তাঁদের জন্য রয়েছে শেয়ারবাজার। তবে বাংলাদেশে শেয়ারবাজার এখনো কারসাজির বড় বাজার, যেখানে নজরদারির অভাব প্রচণ্ড। এর বাইরে অন্যান্য দেশে সাধারণ মানুষের জন্য থাকে বন্ড বাজার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি ভালো বন্ড বাজার তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার মধ্যে আছে। সব দেশই এখন বিনিয়োগ বাড়াতে তৎপর। এ জন্য সুদহার কমানোর উপায়ও খুঁজছে অনেকে। তবে তা অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে থেকেই। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। সুদহার কমাতে হবে এটা এখন সরকারের নির্দেশ। বলা হয়েছে, আগামী এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করতে হবে। এর আওতায় ব্যাংকঋণের সুদহার হতে হবে ৯ শতাংশ এবং আমানতে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ৯ শতাংশ সুদে তা ঋণ হিসেবে প্রদান করবে। এটি ঠিক যে ব্যাংকের বাইরে সব ধরনের সঞ্চয় কর্মসূচির সুদহার বেশি থাকলে খুব কম মানুষই ব্যাংকের কাছে যাবে। আবার উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করার অর্থই হলো সরকারের সুদ পরিশোধের দায় বাড়ানো। আর দীর্ঘ বছর ধরে এই দায় বাড়তে বাড়তে এখন সংকটজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এখন মোট রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশই ব্যয় হয় সুদ পরিশোধে।

সন্দেহ নেই, এত দিন সরকার খুশি মনেই এভাবে দায় বাড়িয়েছে। সরকারের ব্যয় বেড়েছে অনেক। বাড়ানো হয়েছে সরকারি খাতের বেতন-ভাতা। বেড়েছে উন্নয়ন ব্যয়ও। অথচ এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয় বাড়েনি। সুতরাং সরকারকে ঋণ করতেই হয়েছে। আর ঋণ করার ক্ষেত্রে সহজ পথ ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা। ফলে সরকার অবাধে বাড়তে দিয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ। মাঝেমধ্যে মৃদু স্বরে কেউ কেউ সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর কথা বলতেন বটে, তবে খুব বেশি পাত্তা পাননি। কারণ, একটি গোষ্ঠী সব সময় এ নিয়ে ছিল সোচ্চার। এমনকি জাতীয় সংসদেও সঞ্চয়পত্রের পক্ষে বক্তৃতা কম হয়নি। অথচ আমরা সবাই জানি, সাধারণ মানুষ ছাড়াও বড় বড় ব্যবসায়ী, কালোটাকার মালিক, বড় বড় আমলা—এঁরা সবাই বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে রেখেছিলেন। প্রায় এক বছর হলো, সঞ্চয়পত্র বিক্রির রাশ টেনে ধরার একটি চেষ্টা শুরু হয়েছে। নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে বিক্রি কমেছেও যথেষ্ট। এ থেকে প্রমাণ হয়, মুনাফা বা সুদের হার না কমিয়েও সঞ্চয়পত্রের অবৈধ ব্যবহার কমানো সম্ভব।

কিন্তু কাজটি করা হয়নি ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচির ক্ষেত্রে। বরং এক ধাক্কায় তা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। আর শহুরে প্রভাবশালীরা ডাকঘরে অর্থ রাখেন না বলে এর পক্ষে বলারও কেউ নেই। ফলে ‘নয়-ছয়’-এর সহজ ধাক্কায় পড়ল ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচি। আর এতে বিপাকে পড়বেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা। খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে তাতে কীই-বা যায় আসে। বিনিয়োগে বিকল্প ব্যবস্থা না করে এভাবে সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ মানুষের বিপাক বরং বেড়ে যায়।

এখন আমরা বরং এই আশায় থাকি যে ব্যাংকঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশ। আর এতে উদ্যোক্তারা দলে দলে বিনিয়োগ করবেন। কারণ, বাংলাদেশে বিনিয়োগের একমাত্র বাধা উচ্চ হারের সুদ, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিরও একমাত্র কারণ এটি। বিনিয়োগ ঘটলে অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে, ফলে সাধারণ মানুষের আর কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।

এখানে একটি বিভ্রান্তি কাটানোরও প্রয়োজন রয়েছে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও গতকাল রোববার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার কমায়নি, কমেছে ডাকঘরে যে সঞ্চয় কর্মসূচি (স্কিম) রয়েছে এবং সেই কর্মসূচির আওতায় মানুষ যে আমানত রাখছে তার সুদের হার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র সেই আগের মতোই আছে।

নতুন হার অনুযায়ী, সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ, তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ পাওয়া যাবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া দুই বছরের ক্ষেত্রে তা হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।