সংশোধিত এডিপি: নতুন প্রকল্প ঢোকানোর পুরোনো চেষ্টা

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পিঠে দেড় হাজারের বেশি প্রকল্প চড়ে আছে। প্রকল্পের ভারে নুইয়ে পড়া এডিপির অবস্থা এখন অশীতিপর বৃদ্ধের মতো। নতুন বোঝা চাপিয়ে দিলে ওই বয়সের একজন মানুষ কাহিল হয়ে পড়েন। তেমনি বাস্তবায়নগত দুর্বলতার কারণে এডিপি কাটছাঁট করতে গিয়ে তাতে উল্টো তিন শতাধিক নতুন প্রকল্প ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। 

অন্য বছরের মতো এবারও প্রকল্পের টাকা খরচ আশানুরূপ নয়। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এডিপিতে অর্থের জোগানে টান পড়েছে। তাই এডিপি কাটছাঁট অবধারিত। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষে এডিপিতে তিন শর বেশি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব জমা পড়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। অর্থাৎ বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সন্তোষজনক না হলেও সেই পুরোনো পথেই হাঁটছেন এডিপি ব্যবস্থাপকেরা।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৪৫টি প্রকল্প বরাদ্দহীন ও অননুমোদিতভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই তালিকা থেকে গত সাত মাসে শতাধিক প্রকল্প পাস হয়েছে। ওই সব প্রকল্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত এডিপিতে নিয়মিত প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং কিছু বরাদ্দও পেয়ে যাবে। নতুন করে যেসব প্রকল্প সংশোধিত এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০টি পাঠিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ৬০টি প্রস্তাব এসেছে, যার বেশির ভাগই স্থানীয় রাস্তাঘাট উন্নয়নের প্রকল্প। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৪টি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। 

নিয়ম অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব নতুন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়, সেসব প্রকল্পই এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো প্রস্তাব করতে পারে। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রকল্পের দিকে রাজনীতিবিদদের আগ্রহ বেশি। কারণ, তাঁরা এলাকায় গিয়ে বলতে পারেন, উন্নয়নে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার ফলে সার্বিকভাবে প্রকল্প সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে প্রকল্পগুলো পর্যাপ্ত বরাদ্দ পায় না। মেয়াদ বাড়ে, গুণগত মানের কাজ হয় না। এডিপির এই অব্যবস্থাপনা দূর করতে দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা লাগবে। 

>সংশোধিত এডিপি তৈরির কাজ চলছে। এতে নতুন নতুন প্রকল্প ঢোকানোর প্রস্তাব যেমন আছে তেমনি বড় প্রকল্পের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবও আসছে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন খরচসহ মোট ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৩ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল এডিপি হলো ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আগামী মাসেই সংশোধিত এডিপি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এবার এডিপি সংশোধন করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি যৌক্তিক করা হবে। প্রকল্প শেষ করার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে। 

এডিপি কাটছাঁট শুরু

একদিকে রাজস্ব আদায় কম, অন্যদিকে এডিপির বাস্তবায়নের গতিও মন্থর। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবারের মতো এডিপির আকার ছোট করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই সরকারের সামনে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপির মাত্র ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই সময়ে খরচ হয়েছে ৫৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। এমন অবস্থায় প্রতিবারের মতো এডিপি কাটছাঁটের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই গত মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে, তারা বছর শেষে বরাদ্দের কত টাকা খরচ করতে পারবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের চাহিদা পাঠিয়েছে।

এদিকে অনেক বড় প্রকল্প বরাদ্দের টাকা ফেরত দিতে চাইছে। যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ১ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ফেরত দিতে চায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এবার এই প্রকল্পে ৫ হাজার ৩৭০ কেটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পে ৭ হাজার ২১২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এই প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা ফেরত দিতে চায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের টাকার জোগানের সঙ্গে সংগতি রাখতে এবার সংশোধিত এডিপির আকার ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদেশি সহায়তার ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

আগামী মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে এডিপি কাটছাঁট নিয়ে একাধিক বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির চূড়ান্ত খসড়া হবে, যা পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) পাস করা হবে।