তেল-চিনিতে রাজস্ব ঘাটতির 'চাপ', ডাল-পেঁয়াজ-রসুনেও তাপ

চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুনের চড়া দামে মধ্যবিত্তের যখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন নতুন করে চিনির দাম বাড়তে শুরু করেছে। পবিত্র শবে বরাত ও রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারে চিনির বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। পাইকারি বাজারে এই নিত্যপণ্য কেনাকাটা শুরুর মধ্যেই দাম বাড়ল, যার প্রভাব ইতিমধ্যে খুচরা বাজারে পড়েছে।

চিনির দাম কেজিতে মোটামুটি ৫ টাকা বেড়ে খুচরা বাজারে দর উঠেছে ৭০ টাকায়। অবশ্য কারওয়ান বাজারের মতো বড় বাজারে কেজি এখনো ৬৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

চিনি বিপণনকারীরা বলছেন, এ দফায় দাম বাড়ার কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়তি। পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলছেন, এক কেজি চিনিতে এখন সরকারের মোট করভার দাঁড়াচ্ছে ২৫ টাকার মতো। তেল ও চিনির ওপর কর কমানোর সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৭ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাজেটে বাড়তি কর তেল-চিনির দাম বাড়ার একটি কারণ। পবিত্র রমজান মাসে তেল-চিনির সরবরাহ ও দাম স্থিতিশীল রাখতে তারা এ সুপারিশ করছে। অবশ্য এনবিআর এখনো কর কমায়নি।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি এনবিআর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছে বলে জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে তারা এখনো কিছু জানায়নি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার এখন বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতিতে আছে। এ সময় কোনো ধরনের কর কমানোর প্রস্তাব আমলে নেওয়া হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের সাত মাস শেষে বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।

জানতে চাইলে চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর প্রতি টন ৩৮০ ডলারে উঠেছে। দাম যত বাড়ছে, কেজিপ্রতি করের পরিমাণ ততই বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘তেল-চিনির কর নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দেখছি না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে, যা প্রায় পুরোটাই আমদানি করে মেটানো হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ৬০ হাজার টনের মতো।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি আমদানি শুল্ক ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়। আবার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে অগ্রিম কর (এটি) ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়। তখন আমদানিকারকেরা জানিয়েছিলেন, চিনিতে মোট করভার বাড়বে ৫ টাকা। একই ভাবে ভোজ্যতেলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) তিন স্তরে আরোপ করা হয়। এতে ৩ টাকার মতো কর বাড়ে। বাজেটের পরপরই চিনির দাম এক দফা বেড়েছিল।

সমস্যা হয়ে যায় গত বছরের শেষ দিকে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও চিনির দাম বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে গত জুন মাসে বাজেট ঘোষণার পর চিনির দাম পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেজিতে ১৬ টাকার মতো বেড়েছে। শতকরা হিসাবে যা ৩০ শতাংশ।

বাজারে গত ডিসেম্বরের শেষ ও জানুয়ারির শুরুতে খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১২ থেকে ১৫ টাকা ও পাম তেল ২০ টাকার বেশি বেড়েছিল। এখন অবশ্য লিটারে ৫ থেকে ৬ টাকা কমেছে। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকার মতো বাড়িয়েছিল কোম্পানিগুলো, যা আর কমেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এক লিটার সয়াবিন তেলে এখন ১৮ থেকে ২০ টাকা কর পড়ছে।

পুরান ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটের আগে এক কেজি চিনির পাইকারি দর ছিল ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। এখন মিলগেটেই কেজি ৬২ টাকা বলছে।

তেল-চিনির কর নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৭ জুলাই দুটি চিঠি দেয় এনবিআরকে। চিনির ক্ষেত্রে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। একটি হলো চিনির কর কাঠামো আগের মতো রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, শুধু অগ্রিম কর ও অগ্রিম আয়কর তুলে নেওয়া। তৃতীয় প্রস্তাবে এখনকার কাঠামোর বদলে চিনির ওপর কেজিপ্রতি সুনির্দিষ্ট ১৫ টাকা করে কর আরোপের কথা বলা হয়। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছে। এ কারণে একটু ধীরে চলার নীতি নেওয়া হয়েছে। এর কারণ রাজস্ব চিন্তা। তবে বিষয়টি বিবেচনায় আছে।

চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনেও স্বস্তি নেই

বাজারে চালের দাম এখন বেশ চড়া। গত নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে দাম বাড়ছে। রপ্তানিতে প্রণোদনা ঘোষণার পর গত সপ্তাহে দাম আরেক দফা বেড়েছে। বাজারে এখন মধ্যম আয়ের পরিবারে সবচেয়ে জনপ্রিয় মিনিকেট চালের দাম কেজি ৫৫ টাকার আশপাশে। চার মাস আগে এই চাল ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা কেজি ছিল। একই ভাবে মাঝারি মানের চাল ৩৮ থেকে ৪২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গত অক্টোবরে এই চাল ৩৫ টাকার আশপাশে ছিল। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। মোটা চালের দাম সরু ও মাঝারি চালের মতো ততটা বাড়েনি।

পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও ডালের বাজারেও স্বস্তি নেই। দেশি ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২০ টাকায়। তুরস্কের পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজি। গত দুই সপ্তাহে সব ধরনের পেঁয়াজের দর কেজিতে ২০ টাকার মতো কমলেও তা এখনো বেশি। বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের কেজি থাকে ৩০-৪০ টাকা। অর্থাৎ স্বাভাবিকের তুলনায় মানুষের খরচ হচ্ছে তিন গুণ।

মাসখানেক আগে চীনা রসুনের দর ছিল ১৫০-১৬০ টাকা কেজি। চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর দেশে চীনা রসুনের দর ওঠে ২০০-২২০ টাকা। অবশ্য গত সপ্তাহে কেজিতে ২০ টাকা কমেছে। নতুন দেশি রসুন বাজারে উঠেছে। কেজি ১৫০-১৬০ টাকা। বছরের এই সময়ে সাধারণত রসুনের কেজি ৫০-৮০ টাকা থাকে, যা বর্তমানে তিন গুণ বেশি।

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল ছড়িয়ে পড়ার পর মাঝারি ও মোটা দানার মসুরের দর কেজিতে ৭০-৭৫ টাকায় ওঠে, আগে যা ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এ ডাল মূলত আসে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে। সরু মসুরের ডাল কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়ে ১০০-১১০ টাকা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি কর তুলে নেওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় বাজেটে নিত্যপণ্যের ওপর কর বাড়ানো থেকে দূরে ছিল। এবারের বাজেটেই তেল-চিনিতে কর বাড়াতে দেখা গেল।