আয় বেড়ে যাওয়ায় বড় হচ্ছে সয়াবিনের বাজার

জিম শাটার
জিম শাটার
যুক্তরাষ্ট্র সয়াবিন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিম শাটার সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। কথা বলেছেন এখানকার কৃষি মন্ত্রণালয়, সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি ও পোলট্রি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে। এক ফাঁকে প্রথম আলোর সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ


প্রথম আলো: 
বাংলাদেশে সয়াবিনের বাজারের অবস্থা ও সম্ভাবনা কেমন দেখলেন?  

জিম শাটার: বাংলাদেশের মানুষের আয় বাড়ছে। এখানকার জনসংখ্যাও অনেক বেশি। কোনো দেশের মানুষের আয় বাড়লে ভোজ্যতেল, প্রাণিজ আমিষ ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাওয়াদাওয়ার পরিমাণও বাড়ে। তাই মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে সয়াবিনের বাজারও বড় হচ্ছে। বাংলাদেশের যে পরিমাণ সয়াবিন ব্যবহৃত হয়, তার ৬৫ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল বাজার। আমদানি করা সয়াবিন ভাঙিয়ে তেল তৈরি হচ্ছে এখানকার কারখানায়। আবার উপজাত হিসেবে সয়াবিনের কেকও তৈরি করছেন এখানকার কোনো কোনো উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের সয়াবিনের বাজারে আমরা আমাদের অংশীদারত্ব আরও বাড়াতে চাই। তাই এ  সফরে এখানকার উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে কেমন সাড়া পেলেন? 

জিম শাটার: আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে যত সয়াবিন আমদানি হয়, তার বেশির ভাগই আমদানি করে এ দেশের সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ। এ ছাড়া অনেক মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাও এ পণ্য আমদানি করেন। এ ছাড়া পোলট্রি ও গবাদিপশু খাতের উদ্যোক্তারাও গরু-ছাগল ও মুরগির খাবার বা ফিড তৈরিতে সয়াবিন ব্যবহার করছে। আমি এ খাতের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সিটি গ্রুপের সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় গিয়েছি। এখানকার উদ্যোক্তারা বিশ্বমানের সয়াবিন ক্রাশিং প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে, যা দেখে আমি খুবই উৎসাহিত হয়েছি। এ ছাড়া মৎস্য খাতেও সয়াবিনের বড় বাজার আছে। আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সয়াবিনচাষিও এসেছেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য কারা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ভোগ করছেন, তাঁরা তা নিজের চোখে দেখে গেলেন।

প্রথম আলো: কিন্তু আমরা জানি, বাংলাদেশের মুরগি ও গবাদিপশুর খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত সয়াবিনের বড় অংশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা
থেকে আসে।

জিম শাটার: হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত এ দুই দেশ থেকে সয়াবিন কেক বেশি আমদানি হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও পুষ্টিকর। যুক্তরাষ্ট্রে দুই ঋতুতে সয়াবিনের চাষ হয়, কৃষকেরা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার খুবই কম করেন। এ কারণে পুষ্টিগুণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন খুবই উন্নত মানের। শরীরের জন্যও এটি বেশ নিরাপদ। চীনের পাশাপাশি ইউরোপের বেশির ভাগ দেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করে। বিশ্বজুড়ে চাহিদা থাকায় উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ছে নিয়মিত।

প্রথম আলো: বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই কি বাংলাদেশের বাজারের প্রতি আপনারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন?

জিম শাটার: চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা একেবারে বন্ধ করে দেয়নি, তবে আগের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। সেটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যার সঙ্গে সয়াবিনের গুণগত মানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ববাণিজ্যে এ ধরনের টানাপোড়েন অতীতেও বিভিন্ন সময়ে ছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারক শক্তি হচ্ছে চাহিদা ও জোগান। শুধু বাংলাদেশ নয়, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর সুযোগ ও আগ্রহ উভয়ই রয়েছে।

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিনের বেশির ভাগই নাকি জিএম (জিনগতভাবে পরিবর্তিত) প্রযুক্তির জাত থেকে তৈরি। এ নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও পরিবেশবাদীদের অনেক অভিযোগ আছে। 

জিম শাটার: শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর বেশির ভাগ সয়াবিন জিএম প্রযুক্তির জাত থেকে উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ১৯৯৬ সাল থেকে এ ধরনের সয়াবিন খাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। জিএম জাতের সয়াবিনে যে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না, তা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় জাত ও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত সয়াবিনও বিক্রি করে, যদিও সেগুলোর দাম কিছুটা বেশি।

প্রথম আলো: তেল তৈরি ও পোলট্রি খাদ্যের কাঁচামাল ছাড়া অন্য কোনো কাজে কি সয়াবিন ব্যবহৃত হচ্ছে?

জিম শাটার: সয়াবিন প্রোটিনের খুবই ভালো উৎস, তাই অনেক দেশের মানুষ সেটি সরাসরি রান্না করে খায়। জাপানে টফু নামে একটি খাবার আছে, যা সয়াবিন দিয়ে তৈরি করা হয়। এই খাবার জাপানের পুষ্টি সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবীর বহু দেশে সয়াবিন থেকে দুধ, সসসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সয়াবিন তেলের পাশাপাশি এ দেশের মানুষ সয়াবিনের তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবারের দিকেও ঝুঁকবে। এ জন্য দরকার নিরাপদ ও পুষ্টিকর সয়াবিনের ব্যবহার নিশ্চিত করা।

প্রথম আলো: সয়াবিন তেলের কারণে অতি মোটাজনিত সমস্যা বা ওবেসিটি তৈরি হচ্ছে। হৃদ্‌রোগসহ নানা সমস্যার পেছনে পুষ্টিবিদেরা সয়াবিনকে দায়ী করছেন।

জিম শাটার: হ্যাঁ, এটা ঠিক, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অতি মোটাজনিত সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু সেটির কারণ যতটা না সয়াবিন, তার চেয়েও বেশি শারীরিক পরিশ্রম না করা। পাশাপাশি এটাও সত্য, বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের জন্য সয়াবিন খুবই জরুরি খাবার। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীর জন্য সয়াবিনে পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশের অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রেও সয়াবিনের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।