গেরিলা মার্কেটিং

জেব্রা ক্রসিংকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে প্রকাশ
জেব্রা ক্রসিংকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে প্রকাশ

এই বছরের শুরুতে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বানানো দেশি এক টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপন নজর কাড়ে সবার। বছরের সংখ্যাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপারেটিং নম্বরগুলোকে ভিন্ন রং দিয়ে হাইলাইট করে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিকে ইঙ্গিত করা হয়েছিল ছবিটাতে। অপ্রচলিত উপায়ে করা বিজ্ঞাপনের এই ভাষাই হলো গেরিলা মার্কেটিং।   

মার্কেটিং দুনিয়ার লোক না হলে আপনার ‘গেরিলা মার্কেটিং’ শব্দটা না শোনারই কথা। গত শতাব্দীর আশির দশকে লিও বার্নেট এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর জে লেভিনসনের লেখা বইয়ের বদৌলতে মার্কেটিংয়ের এই গেরিলা কৌশল জনপ্রিয় হয়।

অনুমিতভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রের গেরিলা কৌশল থেকেই নাম এসেছে এই গেরিলা মার্কেটিংয়ের। গেরিলা যুদ্ধ যেমন প্রথাগত যুদ্ধের নিয়ম না মেনে বরং ঝটিকা আক্রমণে প্রতিপক্ষকে হকচকিয়ে দেয় খানিকক্ষণের জন্য; গেরিলা মার্কেটিংও তাই। নিয়মিত বিজ্ঞাপনের বাইরে গিয়ে অপ্রচলিত রীতিতে চমক লাগিয়ে গ্রাহক মনে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করাই গেরিলা মার্কেটিংয়ের মূল লক্ষ্য।

টিভি-রেডিও-পত্রিকা-অনলাইনে সাধারণ জনগণ বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে আজকাল এতই অভ্যস্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে এতই বিরক্ত যে প্রথাগত বিজ্ঞাপন তারা সচেতনভাবেই এড়িয়ে যায় বেশির ভাগ সময়। বিজ্ঞাপন বিরতিতে চ্যানেল ঘুরিয়ে অন্য চ্যানেলে হরহামেশাই চলে যায় তারা। কিংবা ওয়েবসাইটের যেসব জায়গায় ব্যানার বিজ্ঞাপন ঝুলে সেখানে তারা আজকাল ভালোমতো নজরই বোলায় না ইদানীং। ঝানু বিপণন কৌশলীরা তাই নিয়ত উপায় খোঁজেন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ কীভাবে করা যায় সে উপায়ের। গেরিলা মার্কেটিং সে জায়গাটা তৈরি করে দেয় বিপণন-সম্পর্কিত কর্মীদের। 

সেন্ট জনস ভার্সিটি ক্যাম্পাসে ‘কোক হ্যাপিনেস মেশিন’ বসিয়ে সহপাঠীদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগির ক্যাম্পেইনটা মার্কেটিং জগতে অবশ্যপাঠ্য। আবার ধরুন, জেব্রা ক্রসিংকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে প্রকাশ করার বুদ্ধি কিংবা কিংবা পার্কের মধ্যে থাকা সিটবিহীন বেঞ্চে বিজ্ঞাপন দেওয়া খানিকটা অভিনব বুদ্ধিই বটে!  

গেরিলা যুদ্ধে একই কৌশল যেমন বারবার প্রয়োগ করলে প্রতিপক্ষ সাবধান হয়ে যায়, গেরিলা মার্কেটিংয়ের একই পদ্ধতি বারবার ব্যবহার করলে সেটা কার্যকারিতা হারায়। তাই অল্প সময়ের জন্য প্রচার করা হলেও এর প্রভাব যেন অনেক দিন থাকে, বা অনেক দিন পরেও যেন লোকজন তা মনে রাখে বা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, সেদিকটায় বেশি খেয়াল রাখা হয়।

গেরিলা মার্কেটিংয়েরও আবার রকমফের আছে, যেমন অ্যামবুশ মার্কেটিং, অ্যাম্বিয়েন্ট মার্কেটিং, স্ট্রিট মার্কেটিং, গ্রাস রুট মার্কেটিং, স্টিলথ মার্কেটিং, এক্সপেরিমেন্টাল মার্কেটিং ইত্যাদি। এসব নিয়ে অন্যদিন আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিকে সূক্ষ্মভাবে খোঁচা দিয়ে বা তার নাকের ডগায় নিজের বিজ্ঞাপন করে ফেলাও গেরিলা মার্কেটিংয়ের অন্যতম সফল কৌশল। মার্সিডিজ বেঞ্চ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএমডব্লিউর এক শতক পূর্তি উপলক্ষে গত এক শ বছর সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভিডিও শুভেচ্ছাবার্তা বানিয়েছিল। সঙ্গে এ–ও জুড়ে দিয়েছিল যে এর আগের ৩০ বছর কিছুটা একঘেয়ে ছিল। 

অর্থের ঝনঝনানি কম থাকায় তুলনামূলক ছোট কোম্পানি বা ব্যবসার ক্ষেত্রে মার্কেটিংয়ের এই গেরিলা কৌশল অধিক কার্যকর। প্রখর কল্পনাশক্তি, সূক্ষ্ম রসিকতা, কপিরাইটিংয়ে শব্দের মুনশিয়ানা—এসব দিয়েই বাজিমাত করা হয় গেরিলা মার্কেটিংয়ে।

কোনো ইভেন্টে অফিশিয়াল স্পনসরশিপ করার অধিকার স্বত্ব যখন থাকে না কোনো কোম্পানির, তখন বেশি প্রয়োগ হয় এই গেরিলা মার্কেটিংয়ের। সে ক্ষেত্রে আবার আয়োজক কিংবা অফিশিয়াল স্পনসরের সঙ্গে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধ তৈরি হয়। ১৯৯৪ সালে নরওয়েতে শীতকালীন অলিম্পিকে অফিশিয়াল স্পনসর ছিল ‘ভিসা’ ক্রেডিট কার্ড। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকান এক্সপ্রেস বিজ্ঞাপন বানিয়েছিল এই বলে যে নরওয়েতে যেতে আপনার পাসপোর্ট দরকার হয়, কিন্তু ভিসা লাগে না।

শেষ কথা এ রকম যে অর্থের বদলে বুদ্ধির ব্যবহারে চমক কিংবা শক দিয়ে অপ্রত্যাশিত উপায়ে কোম্পানির প্রচারণাই হলো গেরিলা মার্কেটিং। তবে আইনি জটিলতা এড়িয়ে সঠিক সময়ে এবং সঠিক স্থানে দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো গেরিলা ক্যাম্পেইন করা মুনশিয়ানার পরিচয়ই বটে!